ইতিহাসের প্রতি টান থেকে আর্কেওলজিস্ট

7218
0

পুরনো ইতিহাস, সভ্যতার বিবর্তন, জীবনশৈলীর খবরাখবর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অভ্যাস অনেকেরই থাকে। ছোটবেলায় বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক গল্প, বই, ছবি কিশোর মনকে উদ্বুদ্ধ করে আদিম জিনিসপত্র সম্বন্ধে জানতে। আর এই ইতিহাস সম্বন্ধে পড়াশুনা করার আগ্রহকেই পরবর্তীকালে পেশা হিসাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের এধরনের ইতিহাস সম্বলিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে পড়াশুনা, কাজকর্ম করার ইচ্ছা রয়েছে, তাঁরা প্রত্নবিদ্যা বা আর্কিওলজির জগতে আসতে পারেন। নিজেকে এক অন্যরকমের চ্যালেঞ্জিং এবং রোমাঞ্চকর কাজের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এই বিষয়ের মাধ্যমে। কাজের বাইরেও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার ভালো সুযোগ থাকে এই পেশায়। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই কাজের জায়গা তৈরি করেছে আর্কিওলজি।

 

আর্কিওলজি কী?

গ্রিক শব্দ `আর্কাইয়স’ অর্থাৎ প্রাচীন সামগ্রী এবং `লোগোস’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে আর্কিওলজি অর্থাৎ প্রত্নতত্ত্ব শব্দের উৎপত্তি। কোনো দেশ বা মহাদেশের নির্দিষ্ট বিলুপ্ত সভ্যতার সামাজিক স্থিতি, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে কাজ করার বিষয়কে সাধারণত আর্কিওলজি বলা হয়। এর পাশাপাশি শুধুমাত্র পুরনো সভ্যতার অংশাবিশেষ, নিদর্শন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য পুনরুদ্ধারই নয়, সেগুলিকে সংরক্ষণ করে সামাজিক স্তরে মানুষের কাছে সেই ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা এবং তথ্য তুলে ধরার দায়িত্বও থাকে আর্কিওলজিস্ট অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিকদের। আর বিষয়গতভাবে দেখলে ভূগোল, ইতিহাস, রসায়ন, ভূতত্ত্ব, সাহিত্য, নৃতত্ত্ব- সবরকম বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই আর্কিওলজি গড়ে উঠেছে। এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করার পর পেশাগতভাবে আর্কিওলজিস্ট হিসাবে কাজ করার জন্য বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা এবং ইতিহাস জানা ও জানানোর প্রতি অফুরন্ত আগ্রহ থাকার প্রয়োজন রয়েছে।

 

কীরকম যোগ্যতা দরকার হয়?

উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর স্নাতক স্তরে আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশুনা করা যেতে পারে। এর সঙ্গে ইতিহাস বিষয়টি থাকলে ব্যক্তিগতভাবে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। অথবা ইতিহাস নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশুনা করার পর স্নাতকোত্তর স্তরে আর্কিওলজির মতো বিষয়কে বেছে নেওয়া যায়, উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য। এর পাশাপাশি সবথেকে বড় বিষয় হল নিজের অনুসন্ধিৎসা থাকা দরকার আর্কিওলজি নিয়ে কাজ করার জন্য। ধৈর্যশক্তি এবং নৈপুণ্যের সঙ্গে কাজ করার অভ্যাস তৈরি করা দরকার। এই বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বাইরের জগতে কাজ করতে হতে পারে, স্বাভাবিকভাবেই সেই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার জন্য মানসিকতার প্রয়োজন।

 

কী ধরনের কোর্স রয়েছে?

আর্কিওলজি নিয়ে স্নাতক স্তরে রয়েছে ব্যাচেলর অব আর্কিওলজি (বিআর্ক) কোর্স, স্নাতকোত্তর স্তরে এমআর্ক কোর্স রয়েছে। এছাড়া ইতিহাস নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়ে থাকলেও স্নাতকোত্তর স্তরে আর্কিওলজি নিয়ে মাস্টারস করা যেতে পারে। রয়েছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্সও। শিক্ষকতার জগতে প্রবেশ করতে চাইলে বা বিষয়টি নিয়ে গবেষণার জন্য পিএইছডির সুযোগও রয়েছে। আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশুনা করে বিভিন্ন শাখায় কাজ করা যেতে পারে, যেমন মিউমিজম্যাটিক্স, এপিগ্রাফি, আর্কাইভস এবং মিউজিওলজি এরকম নানা দিকে। ফলত, নিজের পছন্দ অনুযায়ী নানান শাখায় কাজ করার সুযোগ থাকছে আর্কিওলজি বিষয়ের মাধ্যমে।

 

কোথায় পড়া যায়?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিওলজি বিষয় নিয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনা করা যায়। এমএ বা এমএসসি ডিগ্রি রয়েছে। এর জন্য স্নাতক স্তরে বিএতে ৫২ শতাংশ নম্বর বা বিএসসি অনার্স স্তরে ৫৫ শতাংশ নম্বর প্রয়োজন। এছাড়াও পিএইচডি ডিগ্রি করার সুযোগও রয়েছে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া থেকে দু বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। এই কোর্সে ভর্তির জন্য যোগ্যতা লাগে ৫৫ শতাংশ নম্বর সহ অ্যানশেন্ট বা মেডিঈভল হিস্ট্রি বা আর্কিওলজি বা অ্যানথ্রোপলজিতে মাস্টার ডিগ্রি। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, কালচার এবং আর্কিওলজি বিষয়ের ওপর এমএ কোর্স করানো হয়। এই কোর্সের জন্য ৫০ শতাংশ নম্বর সহ স্নাতক যোগ্যতা দরকার হয়। রাজ্যে বাইরে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি, পাঞ্জাব ইউনির্ভাসিটি সহ একাধিক জায়গায় এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করা যেতে পারে। নানা সার্টিফিকেট কোর্সও করানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুল অব আর্কাইভাল স্টাডিজে।

 

কী ধরনের কাজ হয়?

পুরনো স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সৌধ, ধ্বংসাবশেষ থেকে শুরু করে পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা, অলঙ্কার নানা ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয় আর্কিওলজিস্টদের। এগুলির সময়, স্থান নির্ধারণ, ঐতিহাসিক মূল্য, পিছনের ইতিহাস খুঁজে বের করা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে এঁদের উপর। প্রাথমিকভাবে ফিল্ড ওয়ার্ক, খনন ও কালনির্ণয়গত শ্রেণিবিভাজন দিয়ে কাজের শুরু হতে পারে। এক কথায় বলা যেতে পারে, প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে মানুষের কাছে পরিষ্কার ধারণা তুলে ধরা এবং সেগুলিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ের গুরুদায়িত্ব রয়েছে আর্কিওলজিস্টদের উপর। মানব সভত্য ও সংস্কৃতির অতীতকে বৈজ্ঞানিক ও নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে পুনরুদ্ধার, বিশ্লেষণ এবং ডকুমেন্টেশন এইরকম স্তরভিত্তিক ভাবে কাজ রয়েছে। পেশার জগতে নিউমিসম্যাটিক্স, এপিগ্রাফিস্ট এরকম একাধিক ভাগে কাজ করার সুযোগ থাকে। কাজ হতে পারে প্রশাসনিক স্তর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের কারিগরি স্তর পর্যন্ত নানা ধরনের। কাজের শুরুতে ট্রেনিং, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পেপারস, থিসিস রাইটিং-এর কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে হয়। নিজের কাজের উন্নতি এবং গবেষণার মাধ্যমে কাজের জগতে উন্নতি করা সহজ হবে।

 

পেশার চাহিদা কেমন?

এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে থাকলেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতেই কাজ করার চিন্তাভাবনা স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে মনে আসে। বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজ বা অফিশিয়াল কাজের জন্য এখান থেকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ হয়ে থাকে। এর বাইরেও অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। ইউপিএসসি বা এসএসসির মাধ্যমে সরকারি ক্ষেত্রে বা পরিবেশ রক্ষা বা গবেষণামূলক বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতেও কাজের সুযোগ থাকছে। সরকারি ক্ষেত্রে জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব বিভাগেও কাজ রয়েছে। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী হেরিটেজ ম্যানেজার, ইন্টারপ্রেটর, হিস্টোরিয়ান, সার্ভেয়র এরকম নানা পেশার রাস্তা বেছে নেওয়া যেতে পারে। এর বাইরেও উচ্চতর ডিগ্রি থাকলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা অথবা গবেষণামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা যেতে পারে।

 

একনজরে

১) ইতিহাস-পুরাত্ত্ব-প্রত্নত্ত্ব সম্বলিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে পড়াশুনা, কাজ-কর্ম করার ইচ্ছা যাঁদের প্রবল তাঁরা অনায়াসেই প্রত্নবিদ্যা বা আর্কিওলজির জগতে আসতে পারেন।

২) একটি দেশ বা মহাদেশের নির্দিষ্ট বিলুপ্ত সভ্যতার সামাজিক স্থিতি, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে কাজ করার বিষয়কে সাধারণত আর্কিওলজি বলা হয়।

৩) আর্কিওলজি নিয়ে স্নাতক স্তরে রয়েছে ব্যাচেলর অব আর্কিওলজি (বিআর্ক) কোর্স, স্নাতকোত্তর স্তরে এমআর্ক কোর্স। এছাড়া স্নাতক স্তরে ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলেও স্নাতকোত্তর স্তরে আর্কিওলজি নিয়ে মাস্টারস করা যেতে পারে।

৪) প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে মানুষের কাছে পরিষ্কার ধারণা তুলে ধরা এবং সেগুলিকে বৈজ্ঞানিক গুরুদায়িত্ব রয়েছে আর্কিওলজিস্টদের উপর।

৫) ইউপিএসসি বা এসএসসির মাধ্যমে সরকারি ক্ষেত্রে বা পরিবেশ রক্ষা বা গবেষণামূলক বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতেও কাজের সুযোগ রয়েছে। সরকারি ক্ষেত্রে জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব বিভাগেও কাজ রয়েছে। কাজ হতে পারে প্রশাসনিক স্তর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের কারিগরি স্তর পর্যন্ত নানা ধরনের।