রবীন্দ্রনাথ

1811
0
Rabindranath Picture

বাংলা ভাষা-সাহিত্য যাঁর হাত ধরে বিশ্বলোকে পরিচিতি লাভ করে তিনি রবীন্দ্রনাথ। জীবনের প্রতি পদে সর্বাধিক উদ্ধৃত জীবনশিল্পী। উপনিষদের ভাবনায় বোলপুর শান্তিনিকেতলনে যে আশ্রমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন সেটিই এক সময় শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হয়ে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।স্বাধীনতার অনেক আগে সালে যার গোড়াপত্তন করেছিলেন। শুধু আপন ভাষায়ই নয় বিশ্বের শিক্ষা সংস্কৃতির জন্যও উন্মুক্ত করেছিলেন এই বিদ্যালয়ের দ্বার।দেশ বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন বিদগ্ধ সব পণ্ডিতদের।গড়ে তুলেছিলেন `চিনা ভবন’-এর মতো ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার ক্লাস।পালি সাহিত্য ও ভাষা পড়ানোরও ব্যবস্থা করেছিলেন।ভাষা- সাহিত্য দর্শন-সংগীত সব ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দিয়ে সেরা মনস্বীদের সমাগম ঘটিয়ে ছিলেন এই বিদ্যালয়ে।সেটিই সরকারি স্বীকৃতিতে ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।অনেক শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্বভারতীর মতো অভিনব বিশ্ববিদ্যালয়কে।এজন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তা আমরা জানি। কবির পাশে সেদিন অন্য অনেকের মতো ছিলেন মহাত্মা গান্ধীও। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে সম্বোধন করছেন ‘মহাত্মা’ বলে আর গান্ধী কবিকে বলছেন ‘গুরুদেব’। এই বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে অর্থসংগ্রহের তাগিদে রবীন্দ্রনাথ যেমন স্বদেশের নানান মানুষের কাছে দরবার করেছেন, হাত পেতেছিলেন, তেমনি নিজের নাটক গান কবিতা বক্তৃতা নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে। সারা জীবনে প্রায় ৩০টি দেশে ঘুরেছেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ এই দীর্ঘ সময়ে জাপান, চিন, জাভা, সিংহল, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, লন্ডন, ইতালি থেকে পেরু, আর্জেন্টিনা, পারস্য সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে তাঁর ভ্রমণ। কখনও বক্তৃতায়, কখনও ভ্রমণে, কখনো আমন্ত্রণে। নোবেলে পাওয়া অর্থ ছাড়াও যেখান থেকে যা অর্থ সংগ্রহ করেছেন সবই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে কাজে লাগিয়েছেন। ইউরোপ ও এশিয়ার দেশে-দেশে তাঁর ভ্রমণের নানা কাহিনি নিয়েই কখনও লিখেছেন ‘ইউরোপ যাত্রীর ডায়েরি’, কখনও ‘যাত্রী’(১৯৬১), ‘রাশিয়ার চিঠি’। রবীন্দ্রনাথ সেইসব দেশ থেকে যেমন আহরণ করেছিলেন তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি তেমনই শিল্প-সাহিত্য ভাবনার দ্যোতক হয়ে উঠেছেন নিজে। আর সেইসূত্রেই পেয়েছিলেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ছাড়াও হেনরি বার্গসন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, জর্জ বার্নাড শ, টমাস মান, এইচজি ওয়েলস, উইলিয়াম রাদিচে, চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ, এলম হার্স্ট সহ বিভিন্ন ভাষা-ধর্ম-সাহিত্য-রাজনীতি-অন্যান্য ক্ষেত্রে তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য। তাঁর লেখা গান কবিতা সাহিত্য শুধু বাংলা ও বাঙালিকে নয়, মুগ্ধ করেছিল বিভিন্ন দেশের মানুষকে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এমন দেশ নেই যেখানে অনূদিত হয়নি তাঁর রচনা। ভারতীয় ভাষাগুলি ছাড়াও রাশিয়া সহ ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষা তো বটেই জাপানি, চিনা ভাষা থেকে কোরীয় ভাষায়, পারস্যেও রবীন্দ্রনাথ সমাদৃত হন। জীবনের ৬০ বছর বয়সে কবি রবীন্দ্রনাথ থেকে চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথে উত্তরণ। তাঁর অঙ্কিত সেই সব ছবি গোটা ইউরোপে আলোড়ন তুলেছিল। সে সব নিয়ে শুধু প্রদর্শনীই হয়নি, পৃথিবীখ্যাত সদ্‌বির নিলাম ঘরে লক্ষ-লক্ষ পাউন্ডে তা নিলামে ওঠার কাহিনিও শোনা গেছে। আদায় করে নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শিল্পীদের সঙ্গে সমান আসনে বসার সম্মান। তাই তো দেশে-দেশে প্রান্তে-প্রান্তে তাঁর ভাবনা ও চিন্তাকে নিয়ে আজও চর্চা হয়ে থাকে। সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। শেক্সপিয়রের জন্মভিটেতে একই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাবয়ব মূর্তি। লন্ডন, দক্ষিণ কোরিয়া, আরও বহু দেশে বসানো হয়েছে রবীন্দ্র মূর্তি। ‘গীতাঞ্জলী’ রচনার জন্য ইউরোপের বাইরে প্রথম নোবেলজয়ী লেখক হিসেবে তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিচয় এনে দিয়েছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ দিয়ে শুরু। তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলিও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলির মধ্যে বিবেচিত হতে পারে। তাঁর লেখা দুই সহস্রাধিক গান ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছে। সেই গানের সুরে তিনি মিশিয়েছেন বিভিন্ন দেশের লোকসংগী্তের সুর, আমাদের বাউলের সুর। নানা বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁর রচিত গান ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও রচনা করেন বিশ্বভারতী-ফেরৎ এক কবি। সমাজ সংস্কারক রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের মানুষের অত্যাচারের প্রতিবাদে ব্রিটিশরাজের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়াবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। ভারতীয় স্বাধীনতার মন্ত্রে পথে নেমেছিলেন তাঁর সংগীত নিয়ে। রাখিবন্ধন উৎসবে মুখ্য ভূমিকা যেমন নিয়েছিলেন তেমনই নানা বিষয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারেননি। লিখেছিলেন ‘ঘরে বাইরে’র মতো উপন্যাস। তাঁর গান, কবিতা, নাটক নিয়ে অন্যান্য বছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে তাঁর ১৫৭ জন্মদিন। কবিপক্ষে তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়েই নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে সম্মানে তিনি বিশ্বকবি পরিচিতি পান সেই সম্মানফলককে কে বা কারা চুরি করেছে। জন্মদিনের গৌরবের সঙ্গে-সঙ্গে ২০০৪ সালের মার্চে নোবেল চুরি বাঙালিকে কিছুটা হলেও লজ্জিত করবে। যাকে এ কালের এক মহান কবি বর্ণনা করেছলেন ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলে।