ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান
অ্যাপোলো গ্লেনীগলস হাসপাতাল
সুস্থ থাকার জন্য অনেকে অনেক কিছু করে, বিশেষত আজকের স্বাস্থ্যসচেতনতার যুগে। মানুষের শারীর প্রক্রিয়ার জন্য খাদ্যের চাহিদা যেমন থাকে, সেই চাহিদাগুলো পূরণ হলে তবেই শরীর স্বাভাবিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। চাহিদার বেশি খাবার খাওয়া ও কম খাবার খাওয়া দুক্ষেত্রেই শরীরে নানান রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য প্রত্যেকেরই একটি পরিপূর্ণ ডায়েট প্ল্যান থাকা উচিত।
অনেকে মনে করেন ডায়েট মানেই হল না খেয়ে ওজন কমানো। কিন্তু সেটা কখনওই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। একটি পরিপূর্ণ ডায়েট আপনার দেহের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করবে আবার ওজন কমাতেও সাহায্য করবে। সুস্থ থাকার জন্য রোজকার খাবারে একদিকে যেমন প্রোটিন দরকার, অন্যদিকে তেমনি মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশের জন্য কার্বোহাইড্রেট থাকতে হবে। আর ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য অবশ্যই থাকবে ভিটামিন আর মিনারেলস। সারাদিনে এই ডায়েটটা বজায় রাখা জরুরি।
খাওয়া কমিয়ে দেওয়া কখনওই ঠিক না, অল্প-অল্প ক্যালোরির খাবার খেতে হবে, প্রতি তিন থেকে চার ঘণ্টা অন্তর কিছু না কিছু খাওয়া উচিত। অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে বিএমআর কমে যায়, সেক্ষেত্রে যত কম খাবারই আপনি খান না কেন ওজন দিন-দিন বাড়তে থাকবে। লো ক্যালোরির খাবার প্রতি দু-তিন ঘণ্টা অন্তর খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে লো ক্যালোরির খাবার কী হবে, কার কত ক্যালোরি দরকার, কতটা কম করতে হবে, সারাদিনের ক্যালোরি বুঝে আমরা ডায়েট প্ল্যান করে দিই।
বাইরের খাবার বিশেষ করে জাঙ্ক ফুড খুবই ক্ষতিকর, তাই যাঁরা দিনের বেশিরভাগ সময়টা বাড়ির বাইরে কাটান তাঁদের অবশ্যই বাড়ি থেকে খাবার সঙ্গে নিয়ে রাখা দরকার। বাইরে চা, বিস্কুট বা হালকা কিছু খাওয়া ঠিক আছে কিন্তু ভারী খাবার বাড়ির তৈরি হলেই ভালো। এছাড়াও সারাদিনের একটা ডায়েট প্ল্যান বানিয়ে নিন যেমন সকালে উঠেই খালি পেটে জল খাওয়া ভালো। দিনের শুরু হয় সকালের ব্রেকফাস্ট দিয়ে, ব্যস্ততম কর্মময় দিনে এর অবদান অনেক বেশি। ব্রেকফাস্টে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ভিটামিন এই তিনটে থাকলে খুব ভালো হয়। কর্নফ্লেকস, টোস্ট, সেদ্ধ ডিম, যে-কোনো একটা ফল বা কোনো ফলের রস। সঙ্গে চা-বিস্কুট খেতে পারেন। বাড়ি থেকে রুটি সবজি সঙ্গে নিয়ে রাখতে পারেন, দুপুরের দিকে সেটি খেয়ে নেবেন। এছাড়া দুপুরে ভাত, ডাল, সবজি, মাছও খেতে পারেন। বিকেলের দিকে বাড়ি ফেরার সময় চা, বিস্কুট বা হাল্কা কিছু খাবার খাওয়া যেতে পারে। রাতের খাবারটা তুলনামূলক হালকা রাখতে হবে, তবে ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি থাকলে ভালো। কেউ যদি দুপুরে ভাত খেয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে রাতে রুটিও খেতে পারেন। রাতে খাওয়ার পর অন্তত দশ মিনিট হেঁটে ঘুমোতে যাওয়া উচিত। ঘরে তৈরি রান্না করা খাবার পরিমাণমতো রুটিন মাফিক খেলেই শরীর সুস্থ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
শ্রাবণী ভট্টাচার্য
ডায়েটিশিয়ান
ফর্টিস হাসপাতাল
বর্তমানে ছাত্রছাত্রী ও চাকুরেদের মধ্যে সবথেকে বেশি সমস্যা দেখা দেয় বাড়তি ওজনের, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যানিমিয়া প্রভৃতি। তাই প্রথমেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কেউ-কেউ স্বাস্থ্য সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে নিজেদের মতো করে ডায়েটিং শুরু করে দেন, অতিরিক্ত এক্সারসাইজ করেন, ফলস্বরূপ দেখা দেয় অপুষ্টি, অ্যানোরেক্সিয়া, বুলেমিয়ার মতো সমস্যা। সবসময় একটি ব্যালান্স ডায়েট করতে হবে। প্রধান তিনটে নিউট্রিয়েন্ট প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট এই তিনটে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবারে রাখতে হবে। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকে যেমন ভিটামিন ও মিনারেলস সেগুলিও সমানভাবে থাকবে।
ভাত, রুটি, চিঁড়ে, মুড়ি, খই, বিস্কুট থেকে আমরা কার্বোহাইড্রেট পাই। কার্বোহাইড্রেট দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্য খুব দরকার। আর কমবয়সী ছেয়েমেয়েরা যেহেতু বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাই কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন। ৬০-৭০ শতাংশ ক্যালোরি কার্বোহাইড্রেট থেকে আসা দরকার। ১৫-২০ শতাংশ প্রোটিন থেকে আসবে। অ্যানিমাল প্রোটিন যেমন মাছ মাংস, ডিম, দুধ আবার অন্যদিকে ভেজিটেবল প্রোটিন যেমন ডাল, ছোলা, মটর, বাদাম। ৫০ শতাংশ অ্যানিমাল প্রোটিন, ৫০ শতাংশ প্ল্যান্ট বা সেকেন্ডারি প্রোটিন। ফ্যাট সম্পর্কে সবার ধারণা, ফ্যাট মানেই বিষ। তা কিন্তু একেবারেই নয়, বিভিন্ন হরমোনের গ্রোথ, মিনারেল, হরমোন উৎপাদনের জন্য ফ্যাট দরকার। ২০-৩০ শতাংশ ক্যালোরি আসা দরকার ফ্যাট থেকে। ডায়েটে কিছুটা পরিমাণ ফ্যাট থাকতেই হবে।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের একটা প্রবণতা হল অতিরিক্ত ফাস্ট ফুট ও জাঙ্ক ফুড খাওয়া। এই ধরনের খাবারে ফ্যাট থাকে, তবে তা শরীরের পক্ষে কতটা স্বাস্থ্যকর তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই ফ্যাটযুক্ত ঘরোয়া খাবার খাওয়া ভালো। পোড়া তেলের খাবার একেবারেই খাবেন না, এটি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। ভিটামিন ও মিনারেলের জন্য ফল, সবজি, মিল্ক প্রোডাক্ট। ভিটামিন ও মিনারেল খুব বেশি এনার্জি দেয় না, কিন্তু ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়াতে সাহায্য করে। বৃদ্ধি, বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। প্রচুর জল খেতে হবে। মেয়েদের মধ্যে আজকাল অ্যানিমিয়া রোগটি ভীষণ পরিমাণে দেখা যায়, তাই কিছু আয়রনযুক্ত খাবার ডায়েট চার্টে রাখতে হবে। আয়রনযুক্ত খাবার, মাছ, মাংস, ডিম, ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন পাতিলেবু, টক জাতীয় খাবার, লেবু জাতীয় ফল।
কেউ-কেউ প্রচুর খাচ্ছেন আবার কিছু মানুষ কোনো পরামর্শ ছাড়াই ডায়েটিং করছেন, একদম খাওয়া ছেড়ে দেওয়া, অল্প করে খাওয়া, জল খেয়ে পেট ভরানো এগুলি করে ওজন তো কমবেই না উল্টে শরীরে নানা রোগ দানা বাঁধবে। শরীরে ভিটামিন ও কার্বোহাইড্রেটের ডেফিশিয়েন্সি হবে। উপযুক্ত ডায়েটের পাশাপাশি ব্যায়াম চর্চার অভ্যাস রাখতে হবে। এর ফলে ডায়বেটিস, আর্থারাইটিস, হাইপারটেনশন, ক্যান্সার বা যে সমস্ত রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে তা কমানো যাবে।