করোনা এবং ঝড়েঝাপটায় পাওয়া নতুন শব্দগুলো

1250
0

ভাস্কর ভট্টাচার্য

 

এটা ন্যানো টেকনোলজির যুগ। এটা অনলাইনের যুগ। ঘরে বসেই বিশ্বদর্শনের যুগ বললে ভুল হয় না। সেই আধুনিক বিশ্বেই আমরা এমন এক ভাইরাসের আক্রমণে বা সংক্রমণে কুপোকাত যেখানে ধনী-দরিদ্রের কোনো ভেদ করা যায় না। ভাইরাসটির নামও আবালবৃদ্ধবণিতা সবার জানা— নভেল করোনা ভাইরাস বা সার্স কভ-২। রোগটার নাম কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়েছে বলে বিশ্ব স্বীকৃতি পায়নি। সারা বিশ্বের ২১২টি দেশে এই ভাইরাস এখনও পর্যন্ত আড়াই লক্ষের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যার গ্রাফ ওঠানামা করছে, ৪০ লক্ষের আশপাশে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-ভবিষ্যদ্বাণীতে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই।

 

এই অতিমারী করোনা ভাইরাস আধুনিক জীবনকে এক ঝটকায় গৃহবন্দি বা লকডাউনে কাটাতে বাধ্য করছে, দেশে-দেশে। অত্যন্ত জরুরি পরিষেবা ছাড়া সমস্ত শ্রেণির মানুষ অবরুদ্ধ, একান্ত প্রয়োজনে বাইরে— সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বজায় রেখে। এর আগে অনেক ভাইরাস অগুন্তি প্রাণ কেড়েছে, মানুষের জীবন ছারখার করেছে, কিন্তু সম্ভবত ঠিক এমনভাবে সভ্য সমাজকে গৃহবন্দি করেনি, যা করোনা বা কোভিড-১৯ করেছে।

 

আধুনিক, অত্যাধুনিক জীবনের ছন্দে ব্যাঘাত যেমন ঘটিয়েছে, পাশাপাশি কিছু দিয়েওছে। যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনেকটা ফিরে আসছে দূষণমুক্ত হয়ে, সেকথায় পরে আসছি, তেমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধ জোগান দিয়েছে, যা এই কিছুদিন আগেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অগোচরেই ছিল। এখন সেইসব শব্দের জানকারিতে আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির বা তাঁর গৃহপরিচারিকারও কোনো ভেদ নাই। যেমন, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, কন্টেইনমেন্ট/রেড/অরেঞ্জ/গ্রিন জোন, রেড স্টার, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, জনতা কারফিউ, ক্যারিয়ার, কো-মর্বিডিটি, অ্যাসিম্পটোম্যাটিক, পরিযায়ী শ্রমিক ইত্যাদি। এমন সব নতুন শব্দের পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও সুপরিচিত হচ্ছে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নাম যেমন ট্রুন্যাট পদ্ধতি, সিবিন্যাট পদ্ধতি, এনভেলপ, র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট, বিলিরুবিন টেস্ট, পিপিই (পার্সোন্যাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট, পিএইচআইপিসি অর্থাৎ পাবলিক হেল্থ অ্যান্ড ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোলের মতো নানা শব্দ। প্রত্যেক বড়ো বিপর্যয়ের ঝড়েই এমন কিছু নতুন শব্দ ছড়িয়ে যায়। যেনন কদিন আগেই ঘরে-ঘরে আলোচিত হল হিমোগ্লোবিন-বিলিরুবিনের পর প্লেটলেট, অজানা জ্বর ইত্যাদি। মন্বন্তর-প্লেগ-সুনামিও রেখে গেছে এমন কিছু শব্দভাণ্ডার।

 

একটু অতীত দেখে নেওয়া যাক। শোনা যাক ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান ও ভাইরাসের মরণ কামড়ের কাহিনি। বিজ্ঞান যখন আজকের মতো উন্নত হয়নি, ছিল না কোনো টিকা। ডাঃ জেনার তখনও বিজ্ঞানের ভ্যাকসিন আবিষ্কারক হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হননি। ডক্টর জেনারকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কারক।

 

করোনা ভাইরাসই স্মরণ করাল একশো বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু, তারও দুশো বছর আগের প্লেগ মহামারীর কথা। মাত্র কয়েক বছর আগে সোয়াইন ফ্লুর ভয়াবহতার কথাও। সোয়াইন ফ্লুতে বেশ কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।

 

একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে নাকি বিশ্বে ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল, আক্রান্ত বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। আর তার অনেক আগে প্লেগে মৃত্যু হয়েছিল ইউরোপের অর্ধেক মানুষের। ভারতে প্রায় এক কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। আর সব হিসাব ছাড়িয়ে যে ভাইরাসটি ইতিহাসে সবথেকে প্রাণঘাতী হয়েছিল, তা হল স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত। প্রায় তিরিশ কোটির বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে এই ভাইরাসটি।

 

এখানেই একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। গুটি বসন্তের মতো করোনা ভাইরাসটিও ভাইরাস ঘটিত রোগ যা স্পর্শবাহিত বা থুতু ইত্যাদির ভাসমান সূক্ষ্ম ফোটা হিসাবে শ্বাসবাহিত হয়ে শরীরে ছড়ায়। চলে আসা যাক করোনা কথায়। করোনা ভাইরাস শুধু আধুনিক জীবনের ছন্দই ভঙ্গ করেনি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গতিপথ পালটে দিয়েছে। অন্তত বিজ্ঞানীরা তেমন মতই ব্যক্ত করছেন। যেমন যোগ হল মাস্ক। মুখোশ। গোটা পৃথিবীর ধনী-দরিদ্র মানুষ অদৃশ্য ভাইরাস রুখতে নাক এবং মুখে ভাইরাস রোধক কাপড় ব্যবহারে অভ্যস্ত হলেন। অনুমান করা যায়, এই মাস্ক আগামী দিনে সবার নিয়মিত একটা ব্যবহারযোগ্য আবশ্যকীয় হয়ে উঠবে। নিজে বাঁচতে অন্যকে বাঁচাও, রোগ না ছড়িয়ে। এই স্লোগান নিয়ে।

 

এই লকডাউনে অবরুদ্ধ জীবনে কর্মজীবন থেকে শিক্ষার দুনিয়ায় একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে এল করোনা, তা হল অনলাইন পদ্ধতি। মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ঘর থেকেই অফিসের কাজ সারা, ঘরে বসেই কেনাকাটা, ঘরে বসেই ক্লাসের পাঠ নেওয়া। জোরদার হয়ে উঠছে অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম। আগামী দিন নাকি সমাজের একটা বড় অংশই এই শিক্ষায় অভ্যস্ত হবে। যাকে বলে প্যারাডাইম এডুকেশন। একদিকে ঘরে বসে শিক্ষা অন্যদিকে ওয়ার্ক ফর্ম হোম। ঘরে বসেই অফিসের কাজ সারা, ব্যাঙ্ক থেকে বা পেটিএম ইত্যাদির মাধ্যমে অনলাইন পেমেন্ট— সবেতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম। আমূল পরিবর্তন ব্যবস্থার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাসের এই ভয়াবহতা।

 

আমাদের জীবনে সব থেকে প্রভাব ফেলেছে লক ডাউন বা গৃহবন্দিদশা। লক ডাউন মানে খুব প্রয়োজনীয় দরকার না থাকলে মানুষকে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে। তারই পাশাপাশি পেলাম আমরা ভাইরাসের প্রকোপের কম-বেশির ওপর বিভিন্ন জোন ভাগ। যেমন অতিপ্রবণ রেড জোন, কম প্রবণ অরেঞ্জ জোন, ভাইরাস মুক্ত বা ধরা পড়েনি গ্রিন জোন। তেমনি কন্টেইনমেন্ট জোন বা বাফার জোন যেখানে কোনো বহিরাগত মানুষের আসা-যাওয়া নিষিদ্ধ।

 

ভাইরাস মহামারী সংক্রমণের পাশাপাশি প্রকৃতির খামখেয়ালির ঘটে যাওয়া ঘটনা হড়পা বান, ঘন-ঘন বাজ পড়া, ভূমিকম্প, সুনামি-আইলা জাতীয় নানা সময়ে নানা ঝড়ের নামও পেয়েছি। একদম নতুন ঝড়ের নাম পাচ্ছি ‘আমফান’। এসব মূলত নগরায়ণ তথা বৃক্ষনিধন, সঙ্গে মূলত সিএফসি (ক্লোরোফ্লুরোকার্বন) নিঃসরণ ইত্যাদি কারণে বায়ু বা পরিবেশ দূষণে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ফল। ক্ষয়ে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি রোধক ওজন স্তর, গলছে মেরুদেশের বরফ-হিমবাহ, বাড়ছে সমুদ্রের জলতল। করোনার বিশ্বজোরা লকডাউনের ফলে অনেকটাই ফিরে আসছে প্রকৃতি তথা বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য। মেরামত হয়ে চলেছে ওজোন স্তর, কমছে মেরুদেশের বরফ গলা, ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া বা কমে আসা পাখি-মৌমাছিরা, গঙ্গা-যমুনার জল এখন অনেক পরিষ্কার। কমছে ঘন-ঘন উল্টোপাল্টা খামখেয়ালি নিম্নচাপ।

 

পুরনো কিন্তু এখন অহরহ উচ্চারিত হয় এমন একটি শব্দ দিয়েই শেষ করব। তা হল রিখটার স্কেল। মূলত ভূমিকম্পেই ব্যবহৃত হয়। তার দৌলতেই চিনেছি কম্পনাঙ্ক, ভরকেন্দ্র, আফটারশক। চার্লস ফ্রান্সিস রিখটার ১৯৩৫ সালে ভূকম্প মাপক এই স্কেল আবিষ্কার করেছিলেন।