পঞ্চাশতম বসুন্ধরা দিবসে

1666
0

ভাস্কর ভট্টাচার্য

 

দূষণের ক্ষত সারিয়ে ওজোন স্তর অনেক কমে বায়ুমণ্ডল এই মুহূর্তে কিছুটা হলেও দূষণহীন। অন্তত বিজ্ঞানীদের তেমনই বার্তা। আর এই বার্তার মধ্যেই পঞ্চাশ বছরে পা দিল বসুন্ধরা দিবস। এ বছর বসুন্ধরা দিবস এমন একসময়ে পালিত হচ্ছে যখন পৃথিবীর ১৯২টিরও বেশি দেশ কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের কবলে। চিন থেকে স্পেন, ইতালি থেকে ভারত আজ উক্ত ভাইরাসের অতিমারী আঘাতে-সন্ত্রাসে ছিন্নভিন্ন প্রায়। প্রায় কোনো দেশই বলতে পারবে না আমরা নিরাপদে। একেবারে অজানা অচেনা এই ভাইরাসের ছোবলে গোটা বিশ্বের অন্তত চোদ্দ-পনেরো লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সময়ই বলবে। আমরাও নিয়মিত তার আপডেট দিয়ে চলেছি আমাদের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগে। শুধু বলা যায়, পৃথিবীর এখন গভীর অসুখ। বিজ্ঞানীরা এখন নিরাময়ের পথ সন্ধান করছেন। বিশ্বের নানা মহলে গবেষণার অন্ত নেই। এমনই এক পরিস্থিতিতে ৫০তম আন্তর্জাতিক বসুন্ধরা দিবস। পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার আর্তি বিশ্বের তাবড়-তাবড় দেশের কর্ণধারদের কণ্ঠে। সমাজবিজ্ঞানী থেকে সব মহলের একই সুর― মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের উপর অত্যাচার না করলে আজ হয়তো এমন প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার, বহু প্রজাতির বিলীয়মান পরিস্থিতিতে পড়তে হত না।

 

একটু হিসেব নেওয়া যাক প্রকৃতির প্রতি মানুষের নৃশংসতার। অরণ্য বাতাস জল বন্যপ্রাণী থেকে জীব বৈচিত্র্যর ওপরও নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে মানব’সভ্যতাই’। নগরায়ণের নামে, উন্নয়নের নামে। সম্প্রতি এক বিদেশি গবেষণায় উঠে এসেছে গত শতকের শেষ দুই দশকে ১৭৫টি নতুন রোগের কথা। জানা গিয়েছে, তার ১৩২টি এসেছে বণ্যপ্রাণী থেকে। জিকা, ইবোলা, নিপা, মার্স, মারজুর্গ, সোয়াইন ফ্লু প্রভৃতি। গত ৫০ বছর ধরে বিশ্বে জলাভূমি ভরাট, অরণ্য নিধন, বন্যপ্রাণী নিধন করেছে।  দশ লক্ষ বৃক্ষ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। আট বছরে ১২,২৬৪ বর্গকিলোমিটার বন চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে সভ্যতার শিকারে। এমনই এক পরিসংখ্যান, ভয়াবহ করোনা ভাইরাসের মহামারির মধ্যেই আজ বসুন্ধরা দিবস।

 

অথচ এই বসুন্ধরাকে রক্ষা করতেই আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এক ২২ এপ্রিল তারিখে আমেরিকার পথে-পথে পৃথিবী সুরক্ষা ও সচেতনার বার্তা নিয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী থেকে বিজ্ঞানী পরিবেশবিদ, শিল্পী থেকে কে না পথে নেমে ছিলেন! সেই দিনটা ছিল ২২এপ্রিল ১৯৭০। আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের কয়েক লক্ষ যুবক যুবতী ও সচেতন মানুষ পথে নামলেন। সাধারণ মানুষকে পরিবেশ প্রকৃতি সচেতন করতে।।এই দিন থেকেই সূচনা হয়েছিল আধুনিক পরিবেশ সচেতনার আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ফলে নতুন পরিবেশ আইন তৈরি হয়েছিল, যেখানে নদী, আকাশ বাতাস, জীববৈচিত্র্য বা প্রাকৃতিক প্রাণীকে সুরক্ষার পরিবেশ দেওয়া। তৈরি হয়েছিল এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (EPA)। পরিবেশবিদ গে লর্ড নেলসন ও ডেনিস হে’স এর নামকরণ করলেন ‘আর্থ ডে’ হিসেবে। শুরুর সেদিন কে নেই? বিখ্যাত কার্টুনিস্ট তৈরি করলেন কমিক স্ট্রিপের জন্য পোস্টার যেখানে তিনি লিখলেন, ‘উই হ্যাভ মেট দ্য এনিমি অ্যান্ড হি ইজ উইথ আস’।

 

পথ পেরোল অনেক। আন্দোলন, সচেতনতার বার্তা নিয়ে। দেশে দেশে শুরু হল পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। সেই থেকে বছর বছর হয় আসছে বসুন্ধরা দিবস। আমরা দেখেছি ২০১৬ সালের প্যারিস চুক্তি ছাড়াও রিও ডি জেনেইরো সহ অনেক জলবায়ু দিবস, পরিবেশ সুরক্ষা চুক্তি, মহাসম্মেলন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে শামিল হয়েছিল ১২০টিরও বেশি দেশ।

 

একদিকে মহাসম্মেলন অন্যদিকে গ্রিন হাউস গ্যাস সহ নানান দূষণের সঙ্গেই পরিচিত আজ বিশ্বের মানুষ। অন্যদিকে নগরায়ণের নামে বহুজাতিক হাঙরদের গ্রাসে নাভিশ্বাস বসুন্ধরার। তারই বহিঃপ্রকাশ বন্যা, খরা, বিভিন্ন প্রান্তে।সামুদ্রিক নিম্নচাপ জাত প্রলয়ঙ্কর ঝড়, মহামারি, দাবানল। পরিবেশের ভারসাম্যহীতা। যে ফ্রান্সে গরম কাকে বলে জানা ছিল না সেখানেই নাকি গরম সহ্য করতে না পেরে হাজার-হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। বরফ গলছে শীতল দেশেও। খাদ্যের সন্ধানে নগরের পথে বন্যপ্রাণী। প্রকৃতিও হারিয়ে ফেলেছে তার সহ্যশক্তি।

 

করোনা ভাইরাসের এই ভয়াবহতা থেকে আগামী পৃথিবী কি শিক্ষা নেবে?  এ বছরের অনলাইনে পরিবেশিত বসুন্ধরা কি সেই বার্তাই দেবে?  কারণ সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। মনে পড়ছে সুইডেনের সেই কিশোরীর কথা ষোলো বছর বয়সে গ্রেটা থুনবার্গ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, বাইক চালিয়ে সোজা চলে গেছিলেন সে দেশের কর্তৃপক্ষের দরবারে৷ প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল “স্কুলস স্টপ ফর এনভায়রনমেন্ট”৷ প্রতি শুক্রবার পরিবেশ রক্ষার দাবিতে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রতিবাদে নেমেছিলেন৷ যা বিশ্বে শোরগোল তুলেছিল অবশেষে এই কিশোরী লাইভলিহুড বা নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ তার প্রতিবাদের ছবি আজও আমাদের চোখে ভাসে৷ গ্রেট থুনবার্গ গ্রেট৷ বন্দি বসুন্ধরাতেই পালিত হচ্ছে বসুন্ধরা দিবস৷