পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ

2247
0
prasanta-chandra-mahalanobis-6572

ভাগ্যিস সেদিন পদার্থবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রটি ট্রেন মিস করেছিলেন। তা নাহলে ভারতবর্ষ কি পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে পেত? এ প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। ১৯১২ সাল প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সাম্মানিক ডিগ্রি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে মেধাবী প্রশান্তচন্দ্র কলকাতা থেকে পাড়ি দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পদার্থবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু সেখানে স্টেশনে পৌঁছে দেখলেন ট্রেন চলে গেছে। ঘটনাক্রমে এক পরিচিত বিদেশি বন্ধুর পরামর্শে লন্ডন ইউনিভার্সিটির পরিবর্তে ভর্তি হলেন কেমব্রিজের কিংস কলেজে। সেই কলেজে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশেনো শুরু করেন। একমাত্র তিনিই পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি অর্জন করলেন। কেমব্রিজ তাঁকে প্রদান করল সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ। সেখানেই পেয়েছিলেন দুই প্রথিতযশা বিজ্ঞানীকে। একজন ডব্লিউ এইচ ম্যাকলরে, অন্যজন স্কটিশ নোবেল পদার্থবিদ চার্লস টমসন রিজ। যিনি আবহমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করেন। একদিকে চার্লস টমসনের সঙ্গে ক্যাভেনডিশ গবেষণাগারে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা অন্যদিকে বিজ্ঞানী ম্যাকলরেই এই উৎসাহী বাঙালি তরুণ বিজ্ঞানীর হাতে তুলে দিলেন কয়েক খণ্ডের জার্নাল ‘বায়োমেট্রিকা’। যা তিনি সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। এই বায়োমেট্রিকাই যে প্রশান্তচন্দ্রের জীবনের অন্যতম উপাস্য হয়ে উঠবে তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না। সেই জার্নালই প্রশান্তচন্দ্রের জীবনে পদার্থ বিদ্যার পাশাপাশি নতুন এক ভাবনা জাগাল। বিজ্ঞানের একটি নতুন জগতের দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কেমব্রিজে অত্যন্ত মেধার সঙ্গে চার্লস টমসনের সঙ্গে গবেষণা করতে-করতেই কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। আহ্বান এল প্রেসিডেন্সিতে পদার্থবিদ্যা পড়ানোর। যুক্ত হলেন শিক্ষকতার কাজে। একদিকে শিক্ষকতা অন্যদিকে মনে পড়ল বায়োমেট্রিকার কথা। ইতিমধ্যে তিনি বায়োমেট্রিকার থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখে ফেলেছেন কলকাতায় বসবাসকারী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উপর গবেষণা তথা পরিসংখ্যানমূলক তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ। ডাক পেলেন আবহাওয়া মণ্ডলের পরিসংখ্যানের কাজে। নিযুক্ত হলেন আবহবিদ হিসেবে। পরিসংখ্যান সহ নানান স্ট্যাটিস্টিক্স ধর্মী গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেলন। যা গোটা দেশেই আলোড়ন তুলল। ফ্র্যাকটাইল গ্রাফিক্যাল অ্যানালিসিস পদ্ধতি প্রণয়ন করে মহলানবিশ এক নতুন ধারার জন্ম দিলেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান বুঝতে অত্যন্ত কার্যকরী। বলা বাহুল্য, তাঁর প্রবর্তিত এই কৌশলটিই বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা তিনি শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্সির গবেষণা কক্ষে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর পাশাপাশি। ১৯২০ সালে মহলানবিশ কর্তৃক প্রবর্তিত পরিসংখ্যান গবেষণাগারই ১৯৩১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট রূপ লাভ করে। যা পরবর্তী কালে ভারতের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টিটিউট হিসেবে মর্যাদা পায়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তাঁকে সম্মান জানানো হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের পরিসংখ্যানতত্ত্বের প্রধান পদে ছিলেন। ১৯৫৭ সালে আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের অনারারি প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন। ১৯৬১ সালে আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ফেলো ছাড়াও অসংখ্য সম্মানে ভূষিত হন এই বাঙালি পথিকৃৎ পরিসংখ্যানবিদ। ১৯৬৮ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ খেতাব  ‘পদ্মভূষণ’ গ্রহণ করেন। জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা রূপায়ণে মহলানবিশের প্রদর্শিত পরিসংখ্যানগত ‘ফোর সেক্টর মডেল’ গৃহীত হয়েছিল। পরিসংখ্যান শাস্ত্রে মৌলিক অবদানের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৪ সালে ওয়েলডন পদক প্রদান করে। নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন স্ট্যাটস্টিক্যাল জার্নাল ‘সংখ্যা’(Sankhya). তাঁর প্রবর্তিত আইএসআই এবং ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে ভারতের পণ্যমান নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত।

কলকাতায় এক ব্রাহ্ম শিক্ষিত পরিবারে মহলাবিশের জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৯ জুন। পুরো নাম প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ হলেও পি সি মহলানবিশ নামেই সমধিক পরিচিত। কলকাতার ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে পড়াশেনা শুরু। সেখান থেকে আবিশ্ব পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন নিজস্ব মেধা ও পরিশ্রম দিয়েই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর বি টি রোডের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের বাড়িতে অনেকবার এসেছিলেন। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মতো মানুষদের। সাহচর্যে এসেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিদের। ১৯৭২ সালের ২৮ জুন এই পরিসংখ্যানবিদের জীবনাবসান হয়।