রূপকথার ভুবনজয়ী লক্ষ্যভেদী  নারীরা

1315
0

সেদিন গোটা একান্নবর্তী পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল শ্বেতা মেয়ে হয়ে জন্মেছিল বলে।মা বাবা ছাড়া কেউই খুশি হয়নি সেদিন।আস্তে আস্তে বড় হতে হতে সে বুঝেছিল নারী হয়ে জন্মানোর অপমানের জবাব তাকে দিতেই হবে। সে দিয়েছে। ভদ্রেশ্বরের এক অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের শ্বেতা আগরয়াল আজ একজন দেশের সবচেয়ে সম্মানীয় চাকরি আইএএস পদে কর্মরত। সাধারণ একেবারেই নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। গোটা পরিবারে তিনিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন।
বাবা মায়ের স্বপ্নই ছিল মেয়েকে পড়াশোনা করানোর। শ্বেতাও ছোটবেলায় বাড়ির কাছে খাকি পোশাক পরা পুলিশ অফিসারদের দেখে মনে মনে নিজেও স্বপ্ন দেখত একদিন বড় অফিসার হবে। হুগলির ভদ্রেশ্বরের সেই মেয়েই দেখিয়ে দিয়েছে নিজের জেদ স্বপ্ন এবং প্রচেষ্টা থাকলে কী করে স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব।তাই তো তিনি আজ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলতে পারেন , ‘মনে রেখো সুযোগ এসে দরজায় ঠক ঠক করে না, তোমাকেই তৈরি করে নিতে হবে সুযোগের পথ’। তার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।পড়াশোনাকে করতে হবে জীবন গড়ার মূল মন্ত্র।
একজন লড়াকু মেয়ের এমন স্বপ্নপূরণের কাহিনি শুধু শিহরন জাগায় না, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, চেষ্টা ও লক্ষ থাকলে সবাই পারে নিজের লক্ষ্য ছুঁতে, শুধু তৈরি করে নিতে হবে তোমার লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসিকতা। একজন শ্বেতা আগরওয়ালের কাহিনি পুরনো হতে না হতেই আমাদের চোখের সামনে আরও এক নারী সদ্য ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স অকাডেমির ফ্লাইং অফিসার হওয়ার  সাফল্যের পদক হাতে দেখিয়ে দিলেন লড়াই কাকে বলে, উজ্জ্বল চোখে হাসলেন স্বপ্নজয়ের হাসি ।সঙ্গে নিযুক্ত হলেন ভারতীয় বায়ুসেনার একজন অফিসার হিসাবে। তাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠার লড়াইটাও খুব সহজ ছিল না। সমস্ত প্রতিকূলতাকে পেছনে এগিয়ে গেছেন দরিদ্র পরিবারের মেয়ে অঞ্চল গানওয়াল। বাবা সুরেশ গানওয়ালের রয়েছে একটি চায়ের দোকান। মধ্যপ্রদেশের এক চা বিক্রেতার কন্যা যখন দেশের দায়িত্ববান বায়ুসেনার অফিসার হয়ে ওঠেন তখন এটাই প্রমাণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে নিজের একাগ্রতা ও পরিশ্রম করাটা কত জরুরি। একজন মেয়ে হয়েও  লক্ষ্য জয় করার মনোবল থাকা কত জরুরি।
অঞ্চল কখনওই হেরে যাওয়ার মনোবলকে প্রশ্রয় দেননি।সঙ্গে পেয়েছিলেন পরিবারের উৎসাহ। মেয়ের স্বপ্ন ও শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা পূরণে আর্থিক টানাটানি থাকলেও মেয়ের পড়াশোনায় কোনো প্রভাব পড়তে দেননি। অন্যদিকে অঞ্চল কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রি নিয়ে মধ্যপ্রদেশে পুলিশ বিভাগে চাকরি পেয়ে সেখানেই থেমে থাকেননি।অবশেষে জয় পেলেন। তিনি আজ সংবাদের শিরোনামে।তেমনই সংবাদে এসেছেন কর্নাটকের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কুঁড়ে ঘরের মেয়ে নন্দিনী কে আর এর আইএএস-এ থার্ড রাঙ্ক করার খবর।
শুধু শ্বেতা আগরওয়াল,নন্দিনী বা অঞ্চল গনওয়াল নয়, খুঁজলে এমন আরও সফল  কৃতীর উদাহরণ মিললেও  মিলতে পারে।তাঁরা শুধু নিজেরাই সফল হননি, সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে কী করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, তারই উদাহরণ রেখেছেন। তাই বলার, যদি তুমি দৃঢ়সংকল্প হও, যদি তুমি চেষ্টা করো, সব প্রতিকূলতাকে হারিয়ে তুমিও পারবে ওদের মতো লক্ষ্যে পৌঁছতে।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়,নারীকে প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয়  নানা ক্ষেত্রেই। দারিদ্র,সামাজিক -পারিবারিক বহু ঘটনাকেই অতিক্রম করে অসংখ্য নারী আজ স্বস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতিতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। সে খেলার দুনিয়াই হোক বা অন্য কোনো ক্ষেত্র। হাজার প্রতিবন্ধকতাতেও নিজেদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি।আমরা সার দিয়ে খেলার দুনিয়ার মেরি কম, গীতা গোপীনাথ,হিমা দাস,দীপা কর্মকার , অরুণা রেড্ডি সহ অসংখ্য সফল নারীর ছবি পাই।তেমনি শূন্য থেকে শুরু করে অনেক নারী ব্যবসা ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রতিজ্ঞাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কেউ আবার পরিবারে বঞ্চিত ও ঘর ছাড়া হয়ে আজ দেশের অগ্রগণ্য এক ডিভোর্স ল’ইয়ার হয়েছেন। এবং ভারতের প্রথম নন জাজমেন্ট ডিভোর্স সাপোর্ট গ্রুপের কর্ণধার। লিখেছেন ‘এ লিটিগানটস হিউমারাস পার্সপেক্টিভ অন ডিভোর্স’ নামক বই। শুধু তাই নয়, তৈরি করেছেন ডিভোর্সকার্ট নামে একটি স্বতন্ত্র অ্যাপও।  ভারতে প্রথম, সম্ভবত বিশ্বেও। এই নারীর নাম বন্দনা শাহ। একদিন রাত দুপুরে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
এখানেই আসে দুই অসম সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী দুই নারীর কথা। একজন অরুণিমা সিনহা অন্যজন ভক্তি শর্মা।এই অরুণিমা একজন দিব্যাঙ্গ নারী।যিনি এক পায়েই এভারেস্ট শৃঙ্গে উঠে গোটা দেশে সারা ফেলেছিলেন। অরুণিমা ছিলেন একজন জাতীয় ভলিবল খেলোয়াড়। এক চলন্ত ট্রেন দুর্ঘটনায় একটি পা  বাদ চলে যায়।কিন্তু পা হারিয়েও পাহাড়ে ওঠার স্বপ্ন হারাননি। দেখিয়ে দিয়েছিলেন লক্ষ্য ও জেদ থাকলে কোনো বাঁধাই বাধা নয়। আর দারিদ্র নয়, ভক্তি শর্মা এশিয়ার প্রথম নারী হিসাবে আটলান্টিক মহাসাগরের বরফ শীতল জলে ২.৪ কিমি সাঁতরে পার হয়েছিলেন মাত্র ৪১.৪ মিনিটে।
তাই বলার, মেয়েরা আজ সবক্ষেত্রেই সব বাধা ডিঙিয়ে উঠে আসছেন। সে ইউসাফ মালালার হোক বা সৌদি আরবের নারী বিচারকের পদেই হোক। ইউসাফ মালালা অতি সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সম্মান পেলেন। সবচেয়ে কম বয়সে কোনো মুসলিম নারীর এই সম্মান এক অনন্য নজির সৃষ্টি করল।
বর্তমানে সংবাদপত্রের পাতায় মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে বয়সের আগেই বিয়ে নয়, আরও পড়তে চাই,নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই এই দাবি নিয়ে মেয়েরাই ছুটে যাচ্ছে থানায় অথবা বিডিওর কাছে তখন কিছুটা হলেও মনে হয় কিছু নারীর জাগরণ ঘটছে। এই মুহূর্তে টাটকা সংবাদে উঠে আসা এক দুর্জয় নারীর কথায় শেষ হোক এই লেখা। সেই নারীর নাম সীমা রাও। ভারতের প্রথম মহিলা কমান্ডো প্রশিক্ষক বা ‘ওয়ান্ডার ম্যান’। ডাক্তারি এবং এমবিএ করার পরও সেই পথ ছেড়ে এসে আজ ব্রুস লি-র মার্শাল আর্ট দক্ষতা নিয়েই জওয়ানদের প্রধান প্রশিক্ষক। মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ডের ফাইনালিস্ট, ছবির পরিচালক, ‘ওয়ার্ল্ড পিস ডিপ্লোম্যাট অ্যাওয়ার্ড’ জয়ী সীমা রাও যেন গোটা দুনিয়াকে দেখাতে চাইছেন চেষ্টা ও একাগ্রতা নিয়ে এগোলে সব বাধাকেই জয় করা সম্ভব। যেমন ওরা পেরেছেন।
আর এ কথা ভুললে চলবে না শেখ হাসিনা,অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, জুলিয়া গিলার্ড সহ বিশ্বের ১৩টি দেশের এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন নারীরাই।
                                                                                                                           ভাস্কর ভট্টাচার্য
লাইভ টিভি দেখুন : https://chetana.tv/
বাংলার প্রথম এডুকেশনাল চ্যানেল