১৫ মার্চ: এক স্বঘোষিত সম্রাটের অপমৃত্যু

1560
0

ভাস্কর ভট্টাচার্য

আজকের দিনে ক্যালেন্ডারে ১৫ মার্চ আর পাঁচটা দিনের মতোই। কিন্তু রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাসে বা রোমান ক্যালেন্ডারে গোটা মার্চ মাস, বিশেষ করে ১৫ মার্চ দিনটি স্মরণীয়। দ্য আইডস অব মার্চ। এই দিনটাকে নববর্ষ বলে পালন করত, ছুটির উৎসবে মেতে উঠত, পিকনিক খাওয়া-দাওয়া সহ নানান উৎসব। কিন্তু সেই ১৫ মার্চই পৃথিবী দেখেছিল এক স্বঘোষিত দেবতার অপমৃত্যু।

অজেয় বীর সেই সম্রাট শুধু প্রজাদের কাছে দেবতার সম্মান দাবি করেননি নিজেই নিজের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রোমের মহান শ্রেষ্ঠ পুরুষদের মূর্তির পাশাপাশি। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েও আবার ফিরে এসেছিলেন রোমের মাটিতে। পরাক্রমী রাজা ফারনাসেসকে পরাজিত করে গর্বিত  স্বরেই সেদিন এই সম্রাটের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সেই বিখ্যাত উক্তি ভিনি, ভিডি, ভিসি। যার অর্থ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। একদিকে যদি স্বগর্বিত মহিমার উচ্চারণ, বিপরীতে ঠিক তেমনই এক অসহায় প্রবঞ্চনার সখেদ আর্তনাদ  ব্রুটাস, তুমিও! সৎ, জ্ঞানী, বিশ্বস্ত  ব্রুটাস সহ পরম মিত্রদের যোগসাজসেই প্রাণ দিতে হয়েছিল এই অবিসংবাদিত সম্রাট জুলিয়াস সিজারকে। আর সেই দিনটাও ছিল ১৫ মার্চ। বিশ্বের ইতিহাসে যে কজন বীর পরাক্রমী সম্রাটের নাম গণ্য হয় তাঁদের মধ্যে জুলিয়াস সিজার অন্যতম। উত্থান ও পতনের এক বর্ণময় জীবন। এই সম্রাটেরই আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিল নিজেরই ৬০ জন বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে।

রোমের ইতিহাসে ১৫ মার্চ উৎসবের দিন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের দিন। দেবতা জুপিটারের কাছে উৎসর্গ করার দিন। কেউ ভেড়া, কেউ অন্যান্য সামগ্রী উৎসর্গ করতেন দেবতাকে। চারিদিকে উৎসবের আবহ। কোথাও আয়োজিত হত নানান প্রতিযোগিতা। তেমনই এক উৎসবের মার্চে নিঃসন্তান সিজার স্ত্রী কালফুর্নিয়াকে বলেছিলেন, প্রতিযোগিতায় বন্ধু মার্ক অ্যান্টনি যদি তোমায় কোনও কিছু দিয়ে স্পর্শ করে, তাহলে আমাদের সন্তান হবে।

এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। আদতে তিনি কোনও সংস্কার কোনও পাঁজিপুথি মানতেন না, জ্যোতিষীর ভবিষ্যতবাণীকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকী তাঁর স্ত্রী একদিন যখন এসে তাঁকে বললেন একটা স্বপ্নের কথা, সেই স্বপ্নে তিনি নাকি দেখেছেন তাঁদের পুত্রসন্তান হবে। স্ত্রীর সেই স্বপ্নের কথা শুনে হেসে অবজ্ঞায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেননি যে তাঁর স্ত্রীর দেখা স্বপ্ন সত্যি হবে কোনও দিন। সেই স্বপ্ন
সত্যি না হলেও তাঁর স্ত্রী দেখা এক অশুভ স্বপ্ন কিন্তু সত্যি হয়েছিল। স্ত্রী কালফুর্নিয়া দেখেছিলেন ঘাতকের হাতে সিজারের মৃত্যুর ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন। সে কথা তিনি সিজারকে বলতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও সিজারের হাসি। সেই হাসিতে শুধু অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য। তিনি যে মহান সম্রাট ।

বিশ্বস্ততম বন্ধু ব্রুটাসের হাতে মৃত্যুর ঠিক আগের দিনই ১৪ মার্চ কালফুর্নিয়া ঘুমের মধ্যে অনেক অশুভ স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন সম্রাট সিজারের দিন শেষ। চারিদিকে রক্ত। প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দুঃস্বপ্ন দেখে কালফুর্নিয়া ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলেন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলছেন,  সিজারকে মেরে ফেলছে! চারিদিকে যুদ্ধের দামামা শুনতে পেলেন। স্বপ্নে দেখলেন সেনেট রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই স্বপ্ন
যে এমনভাবে সত্য হবে কে জানত।

১৫ মার্চ মৃত্যুর দিনও সিজার আত্মবিশ্বাসী। কই আমার তো কিছু হল না। সেই দিনই ঘটনাক্রমে সেনেট হাউসে পম্পেই মূর্তির পাদদেশে কাছের মানুষ  ব্রুটাসের হাত কাঁপল না সিজারের বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে। সিজারকে বিশ্বাসের মূল্য দিতে হল প্রাণ দিয়ে। বিধাতা যেন তাঁর জন্মক্ষণে লিখে দিয়েছিলেন তুমি সম্রাট হবে। সত্য-সত্যই সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন। ইউরোপের ইতিহাস তথা সভ্যতার ধারা একাই পালটে দিয়েছিলেন। খ্রিস্টের জন্মের ১০২ বছর আগে এক মে মাসে সিজারের জন্ম। পরবর্তীকালে তাঁরই নামানুসারে সেই মাসের নামকরণ করে সম্মান জানানো হয়েছিল জুলিয়াস সিজারকে। তখন থেকেই সেই মাসটির নাম হয়েছে জুলাই মাস।

জন্ম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। যে পরিবার বিশ্বাস করত তারা স্বর্গের দেবতা ভেনাস এবং ইলিয়াসের বংশধর। বরাবর সেই ধারণাকেই পোষণ করে সিজার নিজেকে গর্বিত বোধ করতেন। পিসেমশাই জেনারেল মারিয়ুসের অনুগামী হয়েই দেবতা জুপিটারের উপাসক পদে বসলেন। কিন্তু সেই সুখ স্থায়ী হয়নি তাঁর জীবনে। পদ ছাড়তে হল স্ত্রীর কারণে। সমাজে দাবি উঠল, হয় স্ত্রীকে ত্যাগ করো নয় দেশ ছাড়ো। তিনি দ্বিতীয় শর্তই মানলেন। স্থির করলেন আইন পড়বেন। কিন্তু না, সেখানে এক নতুন বিপদ এসে হাজির। এক নতুন নেশা, জুয়ার নেশায় ভেসে গেলেন। সেই জুয়াই তাঁকে ক্রমশ অধোগতির দিকে নিয়ে গেল। ক্রমশ দেনা আর দেনায় ডুবতে লাগলেন তিনি। তলিয়ে যেতে-যেতে জুয়ার আগ্রাসী আকর্ষণে দিনের পর দিন ঋণ বেড়েই চলল। সেই গভীর সংকটের দিনে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন এক হিতাকাঙ্ক্ষী। তিনি রোমের বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি ক্র্যাসিউস। ক্র্যাসিউসের শত্রু তখন বীর পম্পেই। যখন-তখন নিঃশেষ হয়ে যেতে পারেন ক্র্যাসিউস। আর তখনই বন্ধুর ভমিকায় অবতীর্ণ হলেন সিজার। পম্পেইর সঙ্গে মিত্রতা করে মধ্যস্থতা করে মিটিয়ে দিলেন উভয়ের শত্রুতা। দুই শত্রু পরিণত হলেন বন্ধুতে। সিজার, ক্র্যাসিউস আর পম্পেই এই ত্রয়ী মিলে রোমে নতুন সাম্রাজ্য গড়লেন। পম্পেই ছিলেন রোমান প্রজাতন্ত্রের এক সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা। এক সময় তিনি ম্যাগনাস দ্য গ্রেট হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।এই ত্রয়ী গোটা রোমে তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। এক সময় সাম্রাজ্য বিস্তারকারী সিজার মিশরে এসে পৌঁছলেন। এই মিশরেই যে তাঁর সর্বনাশের ফাঁদ পাতা রয়েছে তা তিনি বুঝতে পারেননি। সিজার মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়লেন। যে ক্লিওপেট্রা পরবর্তীকালে সিজারের নামানুসারে তাঁর পুত্রের নাম রেখেছিলেন সিজারিওন। মিশরই হয়ে উঠল প্রিয় স্থান। রোমে ফেরার মন নেই। দীর্ঘকাল মিশরে ফারাও রানি ক্লিওপেট্রার সান্নিধ্য তাঁকে বিহ্বল করে দিয়েছিল এক সময়। সেই জুলিয়াস  যখন রোমে ফিরলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। তবু জয় ছিনিয়ে নিলেন রাজা ফারনাসেসকে পরাজিত করে।  জয় তাঁকে ফিরিয়ে দিল তাঁর সাম্রাজ্য, ফিরিয়ে দিল ঐশ্বর্য। তিনি নিজেকে একনায়ক হিসেবে ঘোষণা করলেন। সুশাসক হলেও আত্মশ্লাঘায় ঘোষণা করলেন আমি পরাক্রমী, আমিই দেবতা। সেই ঘোষণার মধ্যেই কোথায় মৃত্যুবাণ লুকিয়ে ছিল যেন। স্ত্রী কালফুর্নিয়ার দেখা দুঃস্বপ্ন কেমন করে যেন সত্য হয়ে উঠল। রোমান ইতিহাসের ক্যালেন্ডারের পাতায় ধর্মীয় উৎসবের ১৫ মার্চের পাশাপাশি এক ঐতিহাসিক সম্রাটের মৃত্যুর তারিখও চিহ্নিত হয়ে গেল। দেবতা জুপিটারের উপাসকের হত্যা। স্বঘোষিত দেবতার অপমৃত্যু। ইতিহাসের পাতায় দগ্‌দগে হয়ে আছে জুলিয়াস সিজারের নৃশংস হত্যার ঘটনা, চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ঐতিহাসিক বিলাপ, “ব্রুটাস তুমিও” !