Site icon জীবিকা দিশারী

ইনোসেন্ট চাইল্ড ভিক্টিম অ্যাগ্রেশন ডে


একটা টাটকা ছোট্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ খবর প্রকাশিত হচ্ছে এমন দিনে যে দিনটা ইউনাইটেড নেশনস দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে ‘ইনোসেন্ট চাইল্ড ভিক্টিম অ্যাগ্রেশন ডে’ হিসেবে (৪ জুন)।  খবরটি মোটামুটি প্রায় সব  দৈনিকেই বের হয়েছে। যেখানে মা-বাবা দারিদ্র সহ্য করতে না পেরে নিজেদের শিশুকন্যাকে মাত্র তিন হাজার টাকাতে হস্তান্তর  করে দেন প্রতিবেশী নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। খবরটা হৃদয়বিদারক হলেও এর মধ্য থেকে একটা বার্তা উঠে আসে। তা হল, সমাজ-সংসারে শিশুদের একটা বড় অংশের ছবি। যেখানে শিশুরা প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে এমনকি স্কুলেও নানাবিধ নিপীড়নের শিকার।
শুধু নিপীড়ন নয়, চলে নানাবিধ অনৈতিক অমানবিক অত্যাচারও। চোরাপথে বিক্রয় থেকে শুরু করে গৃহশাস্তির শিকার আজ সারা বিশ্বের এক বিশালসংখ্যক শিশু। খরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে সারা বিশ্বে লক্ষ-কোটি শিশু চরম অসহায়তার শিকার। এই তো সেদিন এক মৃত পরিযায়ী মায়ের চাদর ধরে টানা নিষ্পাপ শিশুর ছবি গোটা মোবাইল দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে ঘুরেছে। তার কয়েক বছর আগে আমরা সমুদ্রে ভেসে থাকা সেই ফুটফুটে আইলানের ছবি দেখে অশ্রু বিসর্জন করেছিলাম। আমরা যদি ইতিহাসের আরও পিছন দিকে হাঁটি তা হলে দেখব একটা দুটো আইলান নয় লক্ষ লক্ষ আইলান ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়ে ভাসমান জীবন কাটাচ্ছে নানা পীড়ন-আগ্রাসনের শিকার হয়ে।  ইজরায়েল, প্যালেস্তাইন, ইরান, ইরাক, গাজা প্রভৃতি দেশ বা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির দিকে তাকাই তাহলে পরিষ্কার হবে নিষ্পাপ শিশুরা কেমনভাবে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার। সেখানে প্রতিদিন কত শিশুর স্বপ্ন নিষ্ঠুরতায় চাপা পড়ে যায় বা হারিয়ে যায়। ছোট্ট বয়স থেকেই। বইয়ের বদলে হাতে তুলে নিতে হয় বন্দুক। এ যদি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ছবি হয়, তাহলে, কান পাতলে আরেক ভয়াবহ ছবি দেখতে পাব পরিবারে-পরিবারে।  যেখানে পরিবারেই নানা অত্যাচারের শিকার নিরীহ ফুলের মতো শিশুরা। বাবা-মায়ের অত্যাচার ছাড়াও পারিবারিক যৌন নিপীড়নেরও শিকার শিশুদের এক বড় অংশ।
এক সমীক্ষায় বলছে ৮০ থেকে ৯৩ শতাংশ শিশু শুধুমাত্র গৃহশাস্তির শিকার হয় অভিভাবকদের হাতে। এ ছাড়া শিশুশ্রম, প্রত্যঙ্গ বিক্রি, প্রতিবন্ধী সাজিয়ে ভিক্ষার ব্যবসায় শিশু পাচার, যৌন পেশায় রাতের অন্ধকারে বিক্রি হয়ে যাওয়া তো আছেই। চায়ের দোকান, খাবারের দোকান, সোনার বিপজ্জনক অ্যাসিডের কাজে বা বাজি কারখানায় অকালমৃত্যুর ছবি সবার জানা। এক কথায়, বিশ্বের নানা প্রান্তে শিশুরা আজ ভয়ানক অগ্রাশনের শিকার শারীরিক, মানসিক ও আবেগের দিক দিয়ে।
দেখে নেওয়া যাক এক ঝলকে সামান্য পরিসংখ্যানটি। রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া এই তথ্য জানাচ্ছে যে, বিশ্বের ৫০ শতাংশ শিশু প্রতি বছর নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।
বিশ্বে প্রতি পাঁচ মিনিটে ১টি করে শিশুহত্যার ঘটনা ঘটে হিংসাত্মক ঘটনায়।
১৮ বছরের কম বয়সী শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার প্রতি দশ জনের একজন।
দশ জনের ন’জন শিশু শারীরিক শাস্তির শিকার।
বিশ্বের ৭৩.২ কোটি শিশু সামাজিক পারিবারিক কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই বাঁচে।
অনলাইন ভায়োলেন্স দেখতে দেখে বা তার শিকারও হয় আজ সারা দুনিয়ার শিশুরা।
বাড়িতে অভিভাবকদের কাছ থেকে ভয় মার ছাড়া স্কুলেও নানাবিধ অপরাধের শিকার হয় এক অংশের শিশু।
বিশ্বের একটা বড় অংশের শিশু আজও স্কুল শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে।
এইসব নানাবিধ কারণেই সমাজে দিন দিন এক ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা শিশুরা আজ ভয়ানকভাবে বিপন্ন। ২৪.৬ কোটি শিশু বর্তমান বিশ্বে নানাভাবে বিপন্নতার জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এবং নানাবিধ অন্যায় অপরাধের সঙ্গে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়।
এই বিপন্নতার বিষয়ে বিশ্বের মানুষকে সজাগ করতে সমাজ বার্তা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। তার একটা নামও দেওয়া হয়েছিল: ‘ইনোসেন্ট চাইল্ড ভিক্টিম অ্যাগ্রেশন’। প্রতি বছর ৪  জুন উক্ত দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯ সালে এই দিনটি ‘শিশু যন্ত্রণা’ দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এই দিনটির সূচনা হয় গত শতকের আটের দশকে। ইহুদি এবং প্যালেস্তাইন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিপন্ন শিশুদের রক্ষার্থেই এই দিনের সূচনা।লেবানন যুদ্ধে নিহত শিশুদের স্মরণে ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ৪ জুন দিনটিকে ‘ইনোসেন্ট চাইল্ড ভিক্টিম অ্যাগ্রেশন ডে’ হিসাবে চিহ্নিত করে ও শিশু নিরাপত্তার বিষয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা স্মরণ করায়।
যুদ্ধের ভয়াবহতার দিন থেকে নেওয়া শিক্ষা থেকে আজ দিন পাল্টেছে, কিন্তু শিশুরা যে তিমিরে সে তিমিরে।  এখানে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবক থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানদের। শিশুদের শৈশব ঠিক রাখতে হবে, সুসম্পর্ক রাখতে হবে, ভয়, ঘৃণা যেন শিশু মনে জন্ম না নেয় পরিবারে সেটা দেখতেই হবে। যেখানে শিশু সুরক্ষার নিরাপত্তা পাবে প্রথমে পরিবার থেকেই। শিশুর শৈশব রক্ষা করা সমাজের কর্তব্য, বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া নয়। এ নিয়ে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে নানাবিধ কর্মসূচি বা পরিকল্পনা সূচি নিয়েই এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে।
                                                                                                                                                           ভাস্কর ভট্টাচার্য
Exit mobile version