কীর্ণাহারের গ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতির আসনে প্রণব মুখোপাধ্যায়

1195
0

রাজনৈতিক আভিজাত্যের এক মহান প্রতিভূ ছিলেন সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। এমন সুভদ্র, সুমেধা, সুচিন্তক, স্মৃতিপ্রখর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কমই দেখা গেছে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাঙালির এক অনন্য গরিমার ধারাবাহিকতা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে বিরাজ করেছেন শুধু নয়, বাঙালির সংস্কৃতির পরিচয়ের প্রতিভূ হয়েছিলেন যেন তিনি। তাঁর জীবনাবসানে বাঙালি সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে আরও ক্ষীণ হল যেন আভিজাত্যের ঐতিহ্য।

প্রণবাবুর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরে মিরিটি গ্রামে। পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠা এক বিস্তৃত যাত্রাপথ। বাবা ছিলেন একজন স্বদেশি স্বাধানীতা সংগ্রামী। সেই পথ ধরেই একদিন দেশের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন তিনি। প্রথম জীবন শুরু বীরভূমের সিউড়ির কলেজে পড়াশোনা দিয়ে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আইন নিয়েও পাঠ নিয়েছিলেন। রাজনীতিতে আগ্র্হ জন্মালেও তখনও তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে আসেননি। সরকারি পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিসে চাকরি করতে-করতে একদিন স্থির করলেন শিক্ষকতা করবেন। শুরু হল শিক্ষকতা জীবন। ১৯৬৩ দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলার কাছে বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতা করতে-করতেই রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ। তারপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি। কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য। পরবর্তী জীবনে ইন্দিরা গান্ধীর সংস্পর্শে আসা এবং সরাসরি দেশের সর্বভারতীয় দল কংগ্রসের রাজনীতির পরিমণ্ডলে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। এবং ইন্দরা গান্ধীর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠা। সে বিস্তৃত ইতিহাস।

১৯৬৯ সালে রাজ্যসভায় প্রথম পা রাখা। তারপর ১৯৭৩ সালে প্রথমবার মন্ত্রী। সেখান থেকে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে ২০১২ বিরোধী নেতা পি এ সাংমাকে পরাজিত করে ভারতের রাষ্ট্রপতির আসনে প্রথম এক বাঙালির দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে আরোহণ। ২০১৭ সালে সেখান থেকে অবসর। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবন। দল যখনই বিপদের সম্মুখীন হয়েছে তখনই সংকটমোচনে প্রধান দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এগিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখেছেন।

রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হবার আগে তিনি দেশের এমন কোনো দপ্তর ছিল না যার কোনো-না-কোনো পরামর্শদাতা বা দায়িত্ব সামলেছেন। কখনও অর্থমন্ত্রী, কখনও স্বরাষ্ট্রদপ্তর কখনও বিদেশমন্ত্রী, কখনও প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। তাঁর মেধা, বু্দ্ধি প্রাজ্ঞতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি কতটা দায়িত্ববান ও বিশ্বাসভাজন। তাই তো ইন্দিরা গান্ধী সব সময় প্রবল আস্থা রেখছিলেন তাঁর ওপর। রাজনীতির অঙ্গনে কানাঘুষোয় এমনও প্রচার ছিল যে বকলমে প্রণব মুখোপাধ্যায়ই যেন প্রধানমন্ত্রী পর্দার আাড়ালে।

১৯৮০ সালে প্রথমবার অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরই সংস্কারের পথে পা বাড়িয়ে প্রমাণ করেছিলেন তিনি কতটা সফল। সঙ্গে পেয়েছিলেন মনমোহন সিংহের মতো অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদকেও। শুধু কি অর্থ সংস্কার? না, ২০০৫ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েও ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তির নতুন কাঠমো তৈরি করেছিলেন এবং রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা গ্রহণ করে রাশিয়ার মতো দেশকেও কাছে টেনে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। নরসিমা রাওয়ের সময়ে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদ সামলেছেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্বে। ২০০৬-২০০৯ পর্যন্ত পররাষ্ট্রের দায়িত্ব। তার আগে ১৯৯৬ সালে ভারত প্রথমবার যে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির সদস্য দেশ হতে পেরেছিল তার মূল কারিগর ছিলেন প্রণববাবুই। দু দফায় দেশের অর্থমন্ত্রকের পদ সামলানো ছাড়াও বহু অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানে মুশকিল আসানের ভূমিকা নিয়েছিলেন। যেখানেই সমস্যা সেখানেই প্রধান মন্ত্রণাদাতার ভূমিকায় ইন্দিরা গান্ধী পেয়েছিলেন এই প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে। ইন্দিরা ক্যাবিনেটের নাম্বার টু হয়ে উঠেছিনে তিনি। তাঁর আমলেই নিউক্লিয়ার বা পরমাণুচুক্তির মতো ঘটনা ঘটেছিল। এ সব দিক থেকে দেখতে গেলে এক সফল রাজনীতিক। তবে কোথাও যেন একটা ক্ষীণ সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর অবর্তমানে। রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী থাকা সময়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন নিজের দলে। তই তিনি ১৯৮৬ সালে দল থেকে সরে গিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’ নামে নতুন মতাদর্শের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। যদিও পরবর্তী কালে অবশ্য কংগ্রেসেই ফিরে এসেছিলেন।

জ্ঞান পাণ্ডিত্য এবং সংস্কৃতির পরম্পরার ধারক হিসাবেই দেশ একদিন রাষ্ট্রপতির আসনে দেখেছিল এক বাঙালিকে। পেয়েছিলেন ‘পদ্মবিভূষণ’ (২০০৮) ও ‘ভারতরত্ন’ (২০১৯)। দেশে-বিদেশে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন নানা সময়ে। ইস্তাম্বুল, হিব্রু ইউনিভার্সিটি, গোয়া ইউনিভর্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়, কর্নাটকের বিশ্বেশ্বরাইয়া টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি সহ দেশে-বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ও অন্যান্য সম্মানে ভূষিত হন নানা সময়। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর চেয়ারম্যান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। ছিলেন বঙ্গীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টিতেও।

এত সব নানাবিধ কাজের মধ্যেও লেখাপড়া ছিল তাঁর প্রধান অবসর যাপনের বিষয়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞাতা ও লব্ধ জ্ঞান নিয়ই লিখেছিলেন উল্লখেযোগ্য দশটি গুরুত্বপূর্ণ বই। যার অন্যতম ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’, `দ্য ড্রামাটিক ইয়ার’, `দ্য টারবুলেন্ট ইয়ারস, ‘থটস অ্যান্ড রিফ্লেকশনস’-এর মতো রাজনৈতিক বিশ্লষেণমূলক বই।

পেয়েছিলেন ‘বেস্ট ফিনান্স মিনিস্টার ইন ওয়ার্ল্ড’ সম্মান, ১৯৮৪ সালে। ‘ফিনান্স মিনিস্টার অব দ্য ইয়ার’ (২০১০)।

দেশ আজ এক সুশিক্ষিত বুদ্ধি ও মেধার রাষ্ট্রপতিকে হারাল। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে যাঁর ধ্যান জ্ঞান ছিল ভারতীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। রাজনীতির ওঁ প্রতিষ্ঠ করা। প্রণব মানে তো তাইই। রাজনীতিতে তিনি ‘চাণক্য’ নামে পরিচিত ছিলেন। দেশে-বিদেশে শুধু তিনি এই মহান দেশের প্রতিনিধি হয়ে সম্মান প্রাপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে এক মহান বাঙালির পরিচায়কও হয়ে উঠেছিলেন।

 

 

লাইভ টিভি দেখুন:   https://chetana.tv/

বাংলার প্রথম এডুকেশনাল চ্যানেল