Site icon জীবিকা দিশারী

জোহরা সেহগল


আন্তর্জাতিক খ্যাতিসলম্পন্ন ভারতীয় অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী জোহরা সেহগলকে গুগলের পক্ষ থেকে তাদের হোমপেজে গুগল ডুডুল সম্মানিত করা হয়েছে। এক বর্ণবৈচিত্র্যময় নারী এই জোহরা সেহগল। দীর্ঘ জীবন। ১০২ বছর বেঁচেছিলেন। যেমন লম্বা জীবন তেমনি বৈচিত্রম্যয় জীবনের যাত্রাপথ। প্রতি পদে নিজেকে ভেঙেছেন এবং নতুন করে গড়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এক আইকনিক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শুধু অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী বা একজন কোরিওগ্রাফার ছিলেন না বরং শিল্প-শিক্ষার সঙ্গে-সঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীদের সাফল্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন যেন। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত অভিনয়শিল্পী এবং নর্তকী এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন। তাঁর জীবন সহজ ছিল না তবে তিনি একজন দৃঢ়চেতা কঠিন মহিলা ছিলেন। অল্পবয়সে বিধবা হয়েও তিনি কখনও পরিস্থিতির সামনে মাথা নত করেননি। একজন হিন্দু পাত্রকে বিয়ে করার জন্য অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও অকস্মাৎ বিপর্যয় নেমে আসে স্বামীর মৃত্যুতে। দীর্ঘসময় ধরে লড়াই করা এক মুসলিম মহিলার পক্ষে তাঁর স্বামীর অকালমৃত্যুতে দুই যুবতী কন্যা নিয়ে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের কাহিনি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন কী করে লড়াই করে জীবনে নিজের প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে হয়। ব্যতিক্রমী এবং উপমহাদেশের সমস্ত মহিলাদের জন্য একটি উদাহরণ যেন তিনি।

তাঁর আসল নাম সাহেবজাদী জোহরা বেগম মমতাজ-উল্লাহ খান। তিনি তাঁর যুগের এক উচ্চশিক্ষিত মহিলা। তাঁর বাবা মমতাজ-উল্লাহ খান ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের এক অত্যন্ত সম্মানিত ও ধনী ব্যক্তি।

তিনি কামেশ্বর সেহগল নামে এক হিন্দু ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েন। তাঁর বাবা-মার প্রাথমিক বিরোধিতা ছিল, কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই বিয়েতে অনুমোদন দেন।

জোহরা ও কামেশ্বরের দুটি সন্তান ছিল; কিরণ সেহগল এবং পবন সেহগল। কিরণ একজন অত্যন্ত নামী ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। ২০১২ সালে, কন্যা কিরণ সেহগল Zohra Segal ‘Fatty’ শিরোনামে জোহরার একটি জীবনী লেখেন।

তিনি যে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর অংশ ছিলেন তার মধ্যে নীচা নগরআফসার (১৯৪৬), ভাজি অন দ্য বিচ (১৯৯২), দ্য মিস্টিক মাসেউর (২০০১), বেন্ড ইট লাইক বেকহাম (ইংরেজি, ২০০২), দিল সে .. (১৯৯৮), সায়া (২০০৩), সাওয়ারিয়া এবং চিনি কম (২০০৭) অন্যতম। এছাড়াও তিনি দ্য জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন (১৯৮৪), তন্দুরি নাইটস (১৯৮৫–৮৭) এবং আম্মা ও পরিবার (১৯৯৬)-এর মতো টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেন।

২০০২ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি চলো ইশক লড়ায়ে নামক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ভারতীয় মঞ্চ নাটকের চূড়ামণি হিসাবে বিবেচিত জোহরা ১৪ বছর ধরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ) এবং পৃথ্বীরাজ কাপুরের পৃথ্বী থিয়েটারে অভিনয় করেছিলেন।

তিনি ১৯৯৮ সালে পদ্মশ্রী, ২০০১ সালে কালিদাস সম্মান এবং ২০০৪ সালে সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ভারতের জাতীয় সংগীত, নৃত্য ও নাটক একাডেমি তাঁকে আজীবন কৃতিত্বের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান, সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ প্রদান করেছে। ২০১০ সালে তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন। লাহোরের কুইন মেরি কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে, তাঁর মামার কাছে চলে যান এডিনবার্গে। কথিত আছে, দীর্ঘ পথ তাঁরা গাড়িতে করে লাহোর থেকে যাত্রা শুরু করেন। ইরান, প্যালেস্টাইন, দামাস্কাস, সিরিয়া এবং মিশর পেরিয়ে যাওয়ার পথই যেন ছিল এক রোমাঞ্চকর কাহিনি।। ইউরোপে তিনি জার্মানির ড্রেসডেনের মেরি উইগম্যান ব্যালে স্কুলে ভর্তি হন এবং তিনি এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা প্রথম ভারতীয়।

কাউন্টেস লাইবেন স্টেইনের বাড়িতে থাকাকালীন পরবর্তী তিন বছর আধুনিক নৃত্য অধ্যয়নের জন্য ড্রেসডেনে থাকতেন। তিনি তখন উদয় শঙ্করের শিব-পার্বতী ব্যালেটি দেখেছিলেন, উদয়শঙ্কর তখন ইউরোপ ভ্রমণ করছিলেন। অভিনয়টি দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর জীবন চিরতরে বদলে দিয়েছিলেন, উদয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করেন। উদ্য়শঙ্কর তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভারতে আসার। সেই আমন্ত্রণে জোহরা সাড়া দেন। তখন উদয় জাপান রওনা দিচ্ছেন। ১৯৩৫ সালের ৮ আগস্ট জোহরা উদ্য়শঙ্করের ট্রুপে যোগ দেন এবং ফরাসি নৃত্যশিল্পী সিম্কির সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় মহিলা হিসাবে জাপান, মিশর, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে নানা অনুষ্ঠানে নৃত্য প্রদর্শন করেন। ১৯৪০ সালে উদয়শঙ্কর যখন ভারতে ফিরে আসেন, জোহরা তখন আলমোরার উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে শিক্ষক হন।

এখানেই তিনি কামেশ্বর সেগালের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁর প্রেমে পড়েন। সে সময় কামেশ্বর একজন স্বনামখ্যাত তরুণ বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী এবং নৃত্যশিল্পী। যিনি রাধা সোয়ামী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁর চেয়ে আট বছরের ছোট।

১৯৪৫ সালে তিনি বামপন্থী নাট্যদল আইপিটিএতে যোগ দেন এবং ১৯৪6 সালে খাজা আহমদ আব্বাস পরিচালিত, ধর্ম কে লাল পরিচালিত আইপিটিএ-র প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজনায় চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। আইপিটিএ-সমর্থিত ছবি, চেতন আনন্দের নীচা নগর ছবিতে কাজ করেন। প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র যা সমালোচনামূলক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে এবং কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মনোনীত হয়েছিল।

১৯৫৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে জোহরা প্রথমে দিল্লিতে চলে যান এবং তখন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত নাট্য একাডেমির পরিচালক হন। এরপরে তিনি ১৯৬২ সালে লন্ডনে একটি নাটক বৃত্তি নিয়ে চলে এসেছিলেন। এখানে তিনি ভারতবর্ষের ভারতনাট্যম নৃত্যশিল্পী রাম গোপালের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি চেলসির রাম গোপাল স্কুলে নাচের “উদয়শঙ্কর স্টাইলে” শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ব্রিটিশ টেলিভিশনেও কাজ করেছেন।

১০২ বছর বয়সে ১০ জুলাই ২০১৪ সলে মারা যান। জন্ম ১৯১২ সালের ২২ এপ্রিল।

 

ভাস্কর ভট্টাচার্য

 

 

লাইভ টিভি দেখুন:   https://chetana.tv/

বাংলার প্রথম এডুকেশনাল চ্যানেল

 

Exit mobile version