Site icon জীবিকা দিশারী

দূষণের কারণে বিলুপ্তির দিন গুনছে এই গ্রহের লক্ষাধিক প্রজাতি


‘সাইলেন্ট কিলার’ শব্দটি আমাদের অভিধানে নিঃশব্দে জায়গা করে নিয়েছে। এই অদৃশ্য ঘাতক মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। রাষ্ট্রপুঞ্জ গত কয়েক বছর ধরেই নানাভাবে সতর্ক করে চলেছে মানব সমাজকে। কিন্তু কেউ তা শুনলে তো। সম্প্রতি একটা সংবাদ, রাষ্ট্রপুঞ্জেরই দেওয়া। প্রতি বছর ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ নাকি শুধুমাত্র বায়ুদূষণ। আরও শিহরণ জাগায়, এই ৭০ লক্ষের ৬ লক্ষই নিষ্পাপ শিশু। শুধু মৃত্যুর সংখ্যাই যদি হয় এমন, তাহলে বায়ু দূষণে আক্রান্তের সংখ্যাটি কেমন? এই মুহূর্তে ৬০০ কোটিরও বেশি মানুষ দূষিত বাতাস নিতে বাধ্য হন। আরেকটু এগনো যাক, প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ লোকের মৃত্যু হয় শুধুমাত্র বায়ুদূষণের জন্য। এই মুহূর্তের চাঞ্চল্যকর খবর, নেপালের সরকার হিমালয়ের বুকে জমা ৫ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা পরিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে এক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নেপালের এই ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা জানা গেলেও বাকি হিমালয়ের কথা জানা যায়নি। সুদূর দক্ষিণ স্পেনের একটি সৈকতে একটি হোয়াইট স্টর্ক আটকা পড়েছিল নাকি প্লাস্টিকের জালে। ছাড়া পেয়ে সেই স্টর্ক (উজলি) মুক্ত আকাশে উড়ে গিয়েছিল। আর সমুদ্রমুখী হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। ইন্দোনেসিয়ার কোমোডো ন্যাশনাল পার্কের পিঙ্ক বিচও নাকি দ্রতি তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে দূষণের কারণে।যে বিচ দেখতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের আগ্রহী মানুষ ছুটে যান।

এ যদি এই গ্রহের উপরিভাগের দূষণের ভয়াবহতার ছবি হয় তাহলে, সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জেরই ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স-এর একদল বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী শুনিয়েছেন প্রকৃতিতে জীববৈচিত্রের এক ভয়াবহ সংবাদ। যার একটা বিশাল অংশের বাস জলের গভীরে। সীমাহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেপরোয়া লাগামহীনভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের কারণে এই গ্রহের দশ লক্ষ প্রজাতি শুধু বিপন্নই নয়, যে-কোনো সময়েই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাইলের পর মাইল বন ধ্বংসের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে এই বিপুল সংখ্যক প্রজাতির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। আর সেটা ঘটছে বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য নষ্টের কারণেই। বিপদের মুখে শুধু মানুষই নয়, বিপদের মুখে ৪০ শতাংশেরও বেশি উভচর প্রাণী, ৩৩ শতাংশের বেশি প্রবাল প্রাচীর। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অবস্থাও শোচনীয়। দ্রুত বিলুপ্তি ঘটছে সেইসব প্রাণীদেরও। শুনলে অবাক লাগবে এই মুহূর্তে বিশ্বে অ্যামুর লেপার্ডের সংখ্যা নাকি মাত্র ৬০।পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কার তালিকায় এশিয়ান এলিফ্যান্ট, বেঙ্গল টাইগার, ব্ল্যাক ফুটেড ফেরেট, ব্ল্যাক রাইনো, ব্ল্যাক স্পাইডার সহ বহু প্রাণী আজ বিপন্নপ্রায়। শুধু প্রাকৃতিক জীবজগতই নয়, পশুপাখিদের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্য সমাজেও এক বিপুল পরিবর্তন ধরা পড়ছে।তাদের ভাষা সংস্কৃতি উদ্ভিজ্জ প্রাণীদের মতোই ক্রমশই এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন। অন্যদিকে সামুদ্রিক চরিত্র বদলাচ্ছে, অজানা ও ক্ষতিকর প্রজাতির অনেক কীটপতঙ্গের সংখ্যাও বাড়ছে দ্রত গতিতে। দূষণের স্বীকার সমগ্র পক্ষীকুলের প্রায় এক চতুর্থাংশ। আর এই বিলুপ্তির অন্যতম কারণ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ নাকি গ্রিনল্যান্ডের জ্যাকাবশোভান হিমবাহ। উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই এই হিমবাহও নাকি একেবারেই বদলে ফেলেছে তার স্বভাব চরিত্র।

পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূমি জলভূমির উপরিতল। ৬৬ শতাংশ সামুদ্রিক পরিবেশ। এই দুই ক্ষেত্রেই এক বিপুল আবহাওয়াজনিত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। আর এর উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবেশ পরিবর্তিত হওয়ার কারণে এ গ্রহের ৮০ লক্ষ প্রজাতির মধ্যে ১০ লক্ষ প্রজাতির নিশ্চিহ্ন হবার সম্ভাবনা। কচ্ছপ, হাঙর এবং সমগ্রোত্রীয় কয়েক হাজার জলজপ্রাণী বিলুপ্তির পথে, আবার বেশ কিছু প্রাণীর বিবর্তনও ঘটে গেছে প্রাকৃতিক বৈষম্যের কারণেই। বিপন্ন বন্যপ্রাণী। বহু প্রাণী বিরল থেকে বিরতর হয়ে পড়ছে। দূষণ গভীর সমুদ্রের তলদেশেও। যেখানে দশ হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া প্রবাল প্রাচীরের ধসও ঘটে চলেছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সমুদ্রের তলদেশ। যার ফলে জীববৈচিত্রও দূষণে ভারসাম্য হারাচ্ছে। প্রাণিকুল হারাচ্ছে তার বাসভূমি। শুধু জলজপ্রাণীই নয়, ভূপৃষ্ঠের বহু জনজাতি গোষ্ঠীও আজ বিলুপ্তির পথে। বিশাল উপকূলীয় এলাকাগুলি আজ মানুষের দখলে। গবেষণা বলছে, ২৩ শতাংশ ভূমিহীনতার কারণে একদিকে যেমন উৎপাদন কমছে তেমনি সুরক্ষার কারণে বন্যা, হারিকেন (ঝড়), ধস প্রভৃতি কারণে বহু উপকূলীয় এলাকাও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।

আর প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা অধিকাংশেই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন মানুষকেই। আমরা সচেতন না হলে আগামী দিন যে এক বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে তারই আগাম সতর্ক বার্তা দিয়ে চলেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স— পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (আইপিবিএস) সহ বেশ কয়েকটি সংস্থা প্রকৃতির পরিবেশ পরিবর্তন বিষয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করে চলেছেন। ১৯৮৮ সালে ইন্টার গভর্নমেন্টাল ক্লাইমেট চেঞ্জ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট প্রকাশ করে এবং নোবেল পুরস্কারও পায় ২০০৭ সালে। এবার আইপিবিএস জীববৈচিত্রের এই সতর্কতার ছবি তুলে ধরল সচেতন মানুষের কাছে। যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুতন্ত্র, জল এবং বায়ুদূষণ রুখতে, বন্যা রুখতে অনেক বেশি সজাগ হতে হবে মানুষকেই।

Exit mobile version