Site icon জীবিকা দিশারী

বিদ্যাসাগর দ্বিশত বর্ষেও আধুনিকতম


“আমার নষ্ট্ স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হওয়া মাত্রই আমার সময় এবং সামর্থ্য বাঙালিদের মাতৃভাষায় নানারকম প্রয়োজনীয় বিষয়ের গ্রন্থরচনা ও গ্রন্থ সংকলনের কাজে নিয়োগ করব। এই আমার অভিপ্রায়।’’ তাঁর দ্বিশত জন্মদিনে এসে এই মহান মানুষটি বার-বার মনে করান, বাঙালি আজও তাঁর কাছে কতটা ঋণী।

দুশো বছর আগে। যখন গোটা সমাজ চিন্তা-চেতনায় গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেই অন্ধকারে থাকা বাংলা ও বাঙালিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলতে নানা ভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। সমাজ সংস্কারের সঙ্গে-সঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। বিধবা বিবাহ সহ নানা কারণে সমাজের একটা গোঁড়া অংশের মানুষ সেদিন বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে। ব্যঙ্গবিদ্রূপ, আঘাত-নির্যাতন কোনো কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু সেই সময়েও তিনি ছিলেন নিজস্ব চিন্তায় অনড় অটল। সমাজের নানা স্তর থেকে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সত্ত্বেও চুপ করে থেমে থাকেননি সুদৃঢ় মনের এই স্বপ্নদ্রষ্টা। সমাজ সংস্কারে যে বইও হাতিয়ার করতে হবে এ কথা তিনি মনেপ্রাণে বুঝেছিলেন। একদিকে যখন শিক্ষক বিদ্যাসাগর অন্যদিকে তখন তিনি গ্রন্থকার বিদ্যাসাগর।

বাংলা ও বাঙালিকে লিপির পরিচয় ঘটাতেই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ‘বর্ণ পরিচয়’ (১৮৫৫)। যে বইয়ের হাত ধরে বাঙালি শিশু সম্ভবত আজও বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়। যুক্তবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয় ঘটে। এই বর্ণপরিচয়ের আগে যদিও তিনি লিখে ফেলেছিনে বেশ কয়েকটি বই। তাঁর প্রথম অনুবাদিত বই ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। বিক্রমাদিত্য ও বেতাল নামক এক বিশেষ অলোকিক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর মধ্যে গল্প। ১১ শতাব্দীতে যার প্রধান রূপকার ছিলেন সোমদেব। সোমদেবের কথাসরিৎসাগরই পরে বেতাল পঞ্চবিংশতি হয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। আর বিদ্যাসাগর মূল সংস্কৃত থেকে বাঙালির কাছে বাংলা ভাষায় তুলে ধরেছিলেন অবিস্মরণীয় এই কাহিনিকে। শুধু ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ বা ‘বর্ণপরিচয়’ই নয়, নানা সময়ে নানা কাজের মধ্যেই নিরলস প্রয়াস চালিয়ে গেছেন বিভিন্ন শিক্ষামূলক পাঠ সৃষ্টির কাজে। একদিকে যেমন ‘কথামালা’র মতো নীতিকথার অনুবাদ করছেন অন্যদিকে তেমনই বাল্মীকির তপোবনে সীতার নির্বাসিত জীবনের কাহিনি নিয়ে ভবভূতির লিখিত নাটকের অনুবাদ করলেন ‘সীতার বনবাস’। সংস্কৃত ‘উপক্রমণিকা’ বা ‘ব্যাকরণ কোমুদী’র সঙ্গে-সঙ্গে বাংলায় শিশুদের উপযোগী ‘ঋজুপাঠ’ (১৮৫১-৫২)। যে ‘ঋজুপাঠ’ পাঠ পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলা কেটেছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখেছিলন শিশুদের উপযোগী বই ‘সহজপাঠ’।

কথিত আছে বিধবা আন্দোলন নিয়ে যখন গোটা সমাজ উদ্বেলিত তখন সেসময় বিধবাদের সমর্থনে যে পুস্তিকা লিখেছিলেন তা নাকি মাত্র কয়েকদিনে ১৫ হাজার কপি নিঃশেষিত হয়েছিল। সমাজ সংস্কার, বিধবা বিবাহের লড়াইয়ের পাশাপাশি কখনও থেমে থাকেননি শিক্ষাবিস্তারের পথ থেকে। একদিকে ‘ব্যাকরণ কোমুদী’, ‘আখ্যানমঞ্জুরী’  অন্যদিকে বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ ও ‘হর্ষ চরিতম্’ বা ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিতম্’-এর মতো সব বই বিদ্যাসাগর নিরলস ভাবে অনুবাদ করেছেন বাঙালি পাঠকের কাছে সহজ ভাষায় তু্লে ধরতে। তৈরি করেছিলেন ‘শব্দমঞ্জরী’ নামে বাংলাবোধক অভিধান। শেকস্পিয়ারের কমেডি অব এররস অবলম্বনে ‘ভ্রান্তিবিলাস’। বই লেখার সঙ্গে-সঙ্গে বই প্রকাশনার কাজেও যুক্ত ছিলেন। সেই প্রকাশনা থেকে প্রভূত অর্থ আয় করেছিলেন তখন তিনি। বাঙালিকে বই ব্যবসার পথে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

সমাজ সংস্কারে নেমে নারীদের শিক্ষিত করে তুলত প্রাণপাত করেছিলেন। মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ও উদ্যম আজও স্মরণীয়। তিনি প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তার কুড়িটি হুগলি জেলায়, এগারোটি বর্ধমান জেলায়, তিনটি মেদিনীপুর জেলায় এবং একটি নদিয়া জেলায়। প্রয়োজনে নিজের পকেটের অর্থ নির্দ্বিধায় ব্যয় করেছেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষে আজ ২৬ সেপ্টেম্বর করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯ ভাইরাল অতিমারীর সময়ে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মদিনটি। এক আধুনিক নতুন শিক্ষিত সমাজে। তাঁরমধ্যে আমরা পেয়েছিলাম ‘এতস্যৈতেষু শাস্ত্রেসু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ঠ’। ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্তদর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যোতিষ এবং শাস্ত্রীয় আচারানুষ্ঠানে শিক্ষিত এক আদ্যন্ত আধুনিক বাঙালিকে।

 

ভাস্কর ভট্টাচার্য

 

Exit mobile version