সমাজ সংস্কারক, আধুনিক ভারতের প্রবক্তা রাজা রামমোহন রায় জন্মেছিলেন ২২ মে ১৭৭২ সালে অধুনা হুগলির রাধানগর নামক এক অখ্যাত গ্রামে। বাবা শাক্ত মতাবলম্হী হলেও মা ছিলেন তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। তাই ছোটবেলা থেকেই এই দুই ধর্মের সঙ্গে কিছুটা হলেও সম্যক পরিচয় ঘটেছিল। আচারবিচার এবং নানা সংস্কারের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। যা পরবর্তী জীবনে একদম পরিত্যাগ করেছিলেন তিনি। এবং নিজের পিতার সঙ্গেও ঘটেছিল মতবিরোধ। দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকেন প্রতিবাদে। নিজের শিক্ষাদীক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়েই সেই সময়ের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিটা কোম্পানির খুব কাছে দ্রুত চলে এসেছিলেন। প্রপিতামহ ফারুক শিয়র-এর অধীনে সুবেদারের আামিনের কাজ করতেন। ‘রায়্’ পদবী সেখান থেকেই প্রাপ্ত। ‘রাজা’ পদবি পেয়েছিলেন মোগল রাজের কাছ থেকে। পনেরো-ষোল বছর বয়সে রামমোহন বাড়ি থেকে চলে যান এবং কাশী পাটনা প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে বেড়ান। সেই সঙ্গে দ্রুত শিখে নেন নানা ভাষা। সংস্কৃত ভাষার প্রতি তাঁর গভীর টান। পরিচয় হয় নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার বা কুলাবধূত নামে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা এক পণ্ডিতের সঙ্গে। বেদান্তে অনুরাগ জন্মায়। বারণাসীতে থাকাকালীন প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষা করেন এবং সেখান তেকে পাটনায় গিয়ে দ্রুত আরবি ও ফারসি ভাষা শিখে নেন। পরে ইংরেজি, গ্রিক, হিব্রু প্রভৃতি ভাষাও শিক্ষা করেন।
প্রথম জীবনে মহাজনি কারবার শুরু করলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানির কাজ করেন। সংযোগ ঘটে উচ্চপদস্থ নানান ব্যক্তির সঙ্গে। জন ডিগবি তাঁদের অন্যতম। পরে উইলিয়ম কেরির মতো অনেক মানুষের সান্নিধ্য। তখন প্রায়ই কলকাতায় আসতে হত। ১৮১৫ সালে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় বাস। এখান থেকেই তাঁর সংস্কার ভাবনার শুরু। সেই ভাবনা থেকেই ফারসি ভাষায় লিখে ফেলেন ‘তুলফাতুল মুহাহাহিদন’। পাশাপাশি কলকাতায় এসে একেশ্বরবাদ বা ব্রাহ্মবাদ প্রতিষ্ঠাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান ধ্যানজ্ঞান। বেদান্ত উপনিষদ কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন। বাংলায় তার ভাবানুবাদ প্রচার করতে উদ্যোগী হন। লিখে ফেলেন বেদান্তগ্রন্থ, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কাঠোপনিষদ, মাণ্ডুক্যোপনিষদ, ও মুণ্ডকোপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ। নানা সামাজিক বিরুদ্ধতায় মেতে ওঠেন সমস্ত ধরনের সংস্কার বিরোধিতায়। লিখিত বাদ-প্রতিবাদে তৎকালীন সমসাময়িক সমাজে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ রামমোহনকে সমাজচ্যুত করতেও চেয়েছিল। গড়ে তোলেন আত্মীয়সভা যা পরে ব্রাহ্মসমাজ নামে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য ইংরেজি ও বাংলায় ব্যাকরণ রচনা করেন। ইংরেজি শেখানোর উদ্দেশ্যে ১৮২২ সালে ইংরেজি শিক্ষার স্কুলও খোলেন। নারী শিক্ষার পক্ষেও জোরদার সওয়াল করে গেছেন সে সময়ে। এর জন্য অনেক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সতীদাহ প্রথা, পণ প্রথা, শিশুবিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। সতীদাহ প্রথা রদ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলির অন্যতম। বিতর্কের মধ্যেই উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে মার্কিন যুক্তরাজ্যে গমন করেন। ১৮৩৩ সালে সেখানে থাকাকালীনই ব্রিস্টলের কাছে মারা যান। সেখানেই শায়িত রয়েছেন।