শরীরের ভঙ্গিমাগত কিছু সমস্যা বিষয়ে সাবধান

1055
0
sastha-picture

ডঃ শুভেন্দু মৌলিক, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

বর্তমান সভ্যতার যুগে আমরা সবাই ব্যস্ত নিজেদের নানাভাবে সুব্যবস্থিত করতে এবং তার অংশ হিসাবে অত্যাধুনিক আসবাবপত্র বা ফার্নিচার ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা বুঝি না, এর মধ্যে দিয়ে নিজের অজান্তে নিজের কিছু ক্ষতিও আমরা করে থাকি। যেমন, আমরা না জেনেশুনে না বুঝে যে-কোনো জায়গায় বসে পড়ি, বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় বসে একইভাবে কাজ করি। এতে অনেকক্ষেত্রে খুব সহজেই ঘাড়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা ইত্যাদি ব্যাধিতে জর্জরিত হয়ে পড়ি। ভুগতে হয় অস্থিপীড়ন বা স্নায়ুতন্ত্রের পীড়নে। খুব সহজ উদাহরণ মাথাব্যথা, চোখ লাল হওয়া, ঘাড় থেকে নিচের দিকে ব্যথা নামা।

অনেক অফিসেই কর্মীদের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয় কম্পিউটারের সামনে, তাকিয়ে থাকতে হয় স্ক্রিনের বা মনিটরের দিকে। অনেকক্ষেত্রে যে চেয়ারটি ব্যবহার করা হয়, তা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি নয়। তাতে মেরুদণ্ডের উপর প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘদিন ধরে এই প্রদাহ চলতে থাকলে অস্থি নমনীয় হয়ে পড়ে এবং ঘাড়ে পীড়া বা উদর পীড়ার উপক্রম হয়ে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে এভাবে কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখ লাল হওয়া, মাথাব্যথা প্রভৃতি উপসর্গগুলি দেখা দেয়, আবার অনেকের দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে থাকতে-থাকতে পায়ে ঝিনঝিন করা বা পায়ের পাতা ফুলে যেতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কিছু পদ্ধতি যা করলে খুব সহজেই এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। আজকাল যে অত্যাধুনিক চেয়ারগুলি ব্যবহৃত হয়, তাতে বসে দেখে নেওয়া উচিত কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, যদি না হয় তাহলে সেটি ব্যবহার করতে পারেন। যদি কোনো অসুবিধা হয়, তাহলে পরিবর্তন করাই শ্রেয়। মাঝে-মাঝে ১০ মিনিট চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটু হাঁটাচলা করুন, যে মনিটরটি ব্যবহার করছেন তাতে একটি anti glare lens লাগানোর চেষ্টা করুন, তাহলে দেখবেন মাথাধরা ভাব বা চোখ লাল হওয়া বা চোখ জ্বালা ভাব কম থাকবে। পায়ের আঙুলও মাঝে-মাঝে নাড়ানো উচিত।

অনেক সময় আমরা একটি খুব সাধারণ ভুল করে থাকি। সেটি হল, আমরা অনেকেই পকেটে মানিব্যাগ রেখে তার উপর বসি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা মানিব্যাগ পিছন পকেটে রাখি। তাতে আমাদের কোমরের পেলভিস বোনে অস্থিদ্বয়ের গঠনের কিছু স্বভাবগত পরিবর্তন হতে থাকে এবং যখন এই পরিবর্তন আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় তখন খুব শীঘ্রই আমাদের কোমরে ব্যথার শুরু হয়। সেটি সুতোর মতো একটি অংশের মধ্যে দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে এবং স্নায়ুরজ্জুতে প্রদাহের সৃষ্টি করে, যাকে আমরা বলি Sciatica pain । সুতরাং আমাদের এই দিকটি অত্যাবশকীয় ভাবে লক্ষ রাখা উচিত।

আরেকটি সমস্যার কথাও আমারা আলোচনা করতে পারি, যে ছোটবেলা থেকে অনেক অভিভাবক সন্তানদের বিছানায় বা মাটিতে বসিয়ে লেখান বা পড়ান। বা দেখা যায় অনেক সময় শিশুটি খাটের উপর শুয়ে লিখছে। এতে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। প্রথমত, শিশুটি যত বড় হতে থাকে, সে লেখা বা পড়ার সময় অত্যধিক সামনে ঝুঁকে লেখে বা পড়ে। তাতে তার হাতের লেখা যেমন খারাপ হতে থাকে, তেমনি মেরুদণ্ডের আকৃতিগত পরিবর্তন হতে পারে। ধীরে-ধীরে মেরুদণ্ডের পরিবর্তন হয়, সামনের দিকে সে কুঁজো হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, বিছানায় লেখা বা পড়ার অভ্যাস হলে, পরবর্তী কালে যদি সেই শিশুকে অন্য জায়গায় পড়তে বা লিখতে বসতে বলা হয়, তখন সে কথা নাও শুনতে পারে, তার ব্যবহারের তারতম্য ঘটতে পারে। তাই এটা আমাদের মনে রাখতে হবে একবার অভ্যাস হয়ে গেলে সেটিকে পরিবর্তন করা কিন্তু বেশ কষ্টসাধ্য।

আমার একটাই অভিমত সেইসব অভিভাবকদের জন্য: আগে শিশুর বা সন্তানের বসার ভঙ্গিমা ঠিক করুন, তারপরে দেখুন হাতের কোনো সমস্যা আছে কিনা, সেইভাবেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। কারণ ভঙ্গিমা বা অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেখার সময় আমাদের কাঁধ আমাদের শরীরকে Stability দেয় এবং কব্জি থেকে হাতের আঙুল নড়াচড়া করে, অনেক ছোট-ছোট মাংসপিণ্ডের সহায়তায়। তাই আগে আমাদের শরীরের ভঙ্গিমা ঠিক করতে হবে, তারপরে লেখার পবিরর্তনের কথা মাথায় আসবে।

লেখার ক্ষেত্রে আমাদের ভঙ্গিমা সবসময় ৯০ ডিগ্রি অবস্থানে হওয়া উচিত। পা মাটিতে স্পর্শ করা চাই ভালোভাবে, যাতে নিজের ভঙ্গিমা বা অবস্থানকে পরিবর্তন করা যায় লেখার সুবিধামতো। যে টেবিলে রেখে লিখবে, সেই টেবিলের surface চেয়ারে বসা অবস্থায় হাতের ভাঁজ করা কনুইয়ের ঠিক ২ ইঞ্চি উপরে হওয়া উচিত। তাতে শিশুটি সমানভাবে লিখতেও পারবে, লেখাও সুন্দর হবে। এই হচ্ছে একটি ভঙ্গিমার বা proper posture সুবিধা বা অসুবিধা। তবে কোনো রকমের ব্যথাই ফেলে রাখা ভালো নয়, এই ধরনের কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই কোনো থেরাপিস্ট বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।