শিক্ষা থেকে সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর

schedule
2022-07-29 | 23:50h
update
2022-07-29 | 11:23h
person
জীবিকা দিশারী
domain
জীবিকা দিশারী

বাংলা ও বাঙালির নবজাগরণে যে কতিপয় মানুষ আত্মনিয়োগ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অগ্রণী। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে তাঁকে অষ্টম স্থানে বসানো হয়েছে।বাংলা গদ্যের জনক না হলেও বাংলাভাষাকে দাঁড়ি-কমা চিহ্ন দ্বারা সুষমামণ্ডিত সুখপাঠ্য করে তোলার প্রথম প্রয়াস তাঁরই।তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রথম সার্থক গদ্যকার তো তিনিই। ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে প্রথম বর্ণপরিচয় প্রকাশ করে তিনি বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার দু বছর আগে নিজগ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় গড়ে সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন। আজ থেকে দুশো বছর আগে মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে কলকাতা শহরে এসে শুধু নিজে শিক্ষিত হননি, গোটা সমাজে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিতে চেষ্টার অন্ত ছিল না তাঁর।তাঁর হাত ধরেই নারী শিক্ষার এক প্রবল ঝড় বয়ে গেছিল তাঁর সময়ে। তাঁর উদ্যোগেই ১৮৫৭ -৫৮ সালে এক বছরে সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গে প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।আজকের বেথুন কলেজয়িটে স্কুল থেকে বিদ্যাসগর কলেজের গোড়াপত্তন তো তাঁরই অক্লান্ত প্রয়াসে। পাশে পেয়েছিলেন সে সময়ের আরও বহু শিক্ষানুরাগী মানুষকেও। তাঁরাও কম স্মরণীয় নন। এক কথায়, সমাজ সংস্কারক, বিধবা বিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার প্রচলনে বিদ্যাসাগর ছিলেন অগ্রণীর ভূমিকায়।সামগ্রিকভাবে বাংলার নবজাগরণের পুরোধাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর মেধা, পাণ্ডিত্য এবং দরিদ্র-আর্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতিই তাঁকে  একদিকে ‘বিদ্যাসাগর’ অন্যদিকে ‘দয়ার সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেছে।১৮৩৯ সালে হিন্দু ল কমিটির যে পরীক্ষা হয়েছিল তাতে তাঁর পারদর্শিতা দেখে কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রথম দিয়েছিলেন।তার আগে সে সময়ের অলংঙ্কার পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন তিনি। সেই পরীক্ষায় প্রথম হবার সুবাদে পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছিলেন ‘রঘুবংশম’, ‘উত্তর রামচরিত’, ‘মালতীমাধব’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত বই। যে বইগুলি তিনি সহজপাঠ্য অনুবাদ করে বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারই ফল স্বরূপ একে-একে আমরা পেয়েছিলাম আখ্যানমঞ্জরী, কথামালা, সীতার বনবাস, কাদম্বরী, মেঘদূতম, হর্ষচরিত, কিরাতার্জ্জুনীয়, বাল্মিকী রামায়ণ প্রভৃতি অনূদিত সাহিত্যসম্ভার, পেয়েছি শেক্সপিয়রের কমেডি অব এররস-এর রূপান্তরে ভ্রান্তিবিলাস। পেয়েছি অসংখ্য উচ্চমানের পাঠ্যপুস্তকও, সংস্কৃত-বাংলা ভাষাশিক্ষা সহজ করার জন্য সমগ্রব্যাকরণ কৌমুদী। বিধবা বিবাহ প্রচলন হওয়া উচিত কিনা, বাল্য বিবাহ রোধ, যেমন প্রশ্ন তুলেছিলেন তেমনই তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব শিক্ষা সংস্কার, সমাজ সংস্কার।

Advertisement

বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে যে অক্লান্ত সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল আজকের দুনিয়ায় তা অনুমান করা কঠিন। ১৮৪১ কর্মজীবন শুরু। একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলার প্রধান পণ্ডিতের পদ। তারপরের ইতিহাস বিস্ততৃ। সংস্কৃত কলেজ, বেথুন সোসাইটি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই কোনো-না-কোনো ভাবে যুক্ত ছিলেন। নিজ উদ্যোগে সংস্কৃত ডিপোজিটরি প্রেস খুলে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে অনেক সাড়া জাগানো পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন।সেই প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রথম বই বেতাল পঞ্চবিংশতি।আর এই বইতেই প্রথম বিরাম চিহ্নের ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়া রাজার সহায়তায় মুর্শিদাবাদের কান্দিতে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ইংরেজি–বাংলা মাধ্যম স্কুল।১৮৭৩ সালে কলকাতায় গড়ে ওঠা মেট্রোপলিটান কলেজই আজকের বিদ্যাসাগর কলেজ। মেদিনীপুরে তাঁর নামেই গড়ে উঠেছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর নামাঙ্কিত বিদ্যাসাগর সেতু, রাস্তার নামের মধ্য দিয়ে তিনি আজও বাংলা বাঙালির মানসে উজ্জ্বল।১৮৬৪ সালের ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি সদস্য করে নেয়, খুব কম ভারতীয়ই এই সম্মানের অধিকারী। জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০, প্রয়াণ ২৯ জুলাই ১৮৯১।

এখন যে সমাজ চলছে সেই সমাজে এক দলের সঙ্গে আরেক দলের লড়াই।আর সেদিন দুশো বছর আগে জন্মানো এই মানুষটি একাই লড়াই করছিলেন একটা গোটা সমাজের বিরুদ্ধে।যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন হাজারো প্রতিবাদেও তিনি নিজের ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস থেকে চ্যুত হননি। বরং বাধাদানকারীরাই সময়ে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়েছেন।এমনই ছিল তাঁর কাজের প্রতি গভীরতা, একাগ্রতা ও সত্যনিষ্ঠা।আজকের এই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও জাতি-ধর্ম-বর্ণের যে অবক্ষয়িত নগ্ন চেহারা সমাজের নানা দিকে দৃষ্ট হচ্ছে এমন দুঃসময়ে তাঁর মতো আদর্শ সত্যনিষ্ঠ আলোকবর্তী পুরুষের বড়ই অভাব অনুভূত হয়। যে শিক্ষার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছিলেন সেই শিক্ষাঙ্গনেই আজ তিনি লুণ্ঠিত।আজও নারীর অবমূল্যায়ন-অবমামনা, বাল্যবিবাহ সমাজ থেকে নির্মূল করা যায়নি। জাতের নামে বজ্জাতি বেড়েছে বই কমেনি। সমাজের এই দিকগুলি নির্মূল করাই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো। অনেক বেশি কাজের ও প্রয়োজনীয় হবে স্কুলছুটদের স্কুলে টেনে আনা ও বিদ্যায়তনগুলিকে প্রকৃতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। এমন এক সময় আমরা এই মানুষটির দুশো বছর সমহিমায় পালন করছি যখন বাংলা ভাষা এবং বাঙালির আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বাঙালির বাঙালিত্ব নিয়ে সব মহলে সংশয়বিদ্ধ আলোচনা বিদ্যমান। বাংলা ভাষার স্কুলগুলির পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।

Advertisement

Imprint
Responsible for the content:
jibikadishari.co.in
Privacy & Terms of Use:
jibikadishari.co.in
Mobile website via:
WordPress AMP Plugin
Last AMPHTML update:
21.04.2024 - 12:50:11
Privacy-Data & cookie usage: