সংস্কার আর গোঁড়ামির অন্ধকার থেকে নতুন চেতনা দিয়েছিলেন

schedule
2019-05-23 | 13:11h
update
2019-05-23 | 13:11h
person
জীবিকা দিশারী
domain
জীবিকা দিশারী

রামমোহন রায় জন্মেছিলেন এমন এক সময় যখন এই বাংলার বুকে চারিদিকে তমিস্রা। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। সেই অন্ধকার ভেদ করে এক নতুন যুগের বার্তা দিতে তাঁকে ঘরে-বাইরে প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়েছিল। তিরস্কৃত, ধিক্কৃত হতে হয়েছিল পরিবারের মধ্যেই। কিন্তু তিনি থামেননি। নিজে চোখে দেখেছিলেন পরিবারের এক নারীর জ্বলন্ত চিতার লেলিহান শিখায় সহমরণের জীবন্ত আর্তনাদ। সেদিনই তিনি মনে-মনে স্থির সংকল্পে ব্রতী হয়েছিলেন এই সংস্কার ভাঙতেই হবে। গোঁড়া অন্ধ সহমরণের কঠিন জগদ্দলকে সরাবার কঠিন ব্রতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেই কাজে অনেককে সঙ্গে পেলেও সঙ্গে পাননি সমাজের অধিকাংশকেই।‘সতীদাহ প্রথা’ বিলুপ্তির জন্য দুস্তর পথ তাঁকে পার হতে হয়েছিল। একদিকে সমাজের নীতিবাগীশ ব্র্যাহ্মণ্যবাদ অন্যদিকে অশিক্ষা। আজ থেকে এত বছর আগে তাঁকে কী কঠিন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আজ আমরা অনুধাবন করতে পারব না, কিন্তু সেদিন তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক।

১৭৭২ সালে ২২ মে হুগলির রাধানগর গ্রামের এক নিতান্ত সাধারণ পরিবারে জন্ম। বাবা রামকান্ত বৈষ্ণব মনোভাবাপন্ন, মা তারিণীদেবী তান্ত্রিক ঘরানার। এই দুইকেই তুচ্ছ ও অবজ্ঞা করতে শিখেছিলেন সেই শৈশবেই। গ্রামে শিক্ষা শুরুর পর-পরই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিহারের পাটনায়। সেখানে হাতেখড়ি ভিন্ন ভাষা শিক্ষায়। তারপর একে-একে সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি, আরবি, লাতিন— এসবের পাশাপাশি গ্রিক ভাষাতেও তাঁর ব্যুৎপত্তি জন্মায়। নানা ভাষার শিক্ষার পাশাপাশি সর্বজনীন মহাবিশ্বের শিক্ষার আলো তাঁর চোখেমুখে। তিনি মনে করতেন শিক্ষাই মানুষের মনের সব অন্ধকারকে ঘুচিয়ে দিতে পারে। পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ভারতীয় শিক্ষার অঙ্গনে নতুন ভাবে মিলন ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাই যখন পাটনায় মাদ্রাসায় পাঠ নিচ্ছেন তখনই পাশ্চাত্যের শিক্ষার আলো নূতন উন্মেষ ঘটাচ্ছে তাঁর মনে। একদিকে বেদান্তসার উপনিষদে হাতড়াচ্ছেন হিন্দু সংস্কৃতির শিকড়, অন্যদিকে দ্বারকানাথের সঙ্গে নতুন রূপে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা। যেখানে ‘একেশ্বরবাদ’কেই প্রাধান্য। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের সেইসব নবচেতনার উন্মেষের দিনেই ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে হিন্দু কলেজ তৈরি, ১৮২২ সালে অ্যাংলো–হিন্দু স্কুল, বেদান্ত কলেজ সহ নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তারই পথ ধরে ১৮৩০ সালে শিক্ষাবিদ আলেকজেন্ডার ডাফ-এর সঙ্গে গড়ে ওঠে জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশন বর্তমানে যা স্কটিস চার্চ চলেজ। প্রেসিডেন্সি কলেজ গড়ে তোলার মূলেও তাঁর অশেষ অবদান। ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এর পাশাপাশি গড়ে তোলেন ‘আত্মীয় সভা’র মতো প্রতিষ্ঠান। গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তখন তাঁকে নানা তির্যক অপমানে লাঞ্ছিত করতেও ছাড়েনি। ছড়া কেটে ফিরতেন একদল বিরোধী। যেখানে বলা হয়েছিল- “ব্যাটা সুরাই মেলের কুল/ব্যাটার বাড়ি খানাকুল,/ব্যাটা সর্বনাশের মূল।/ওঁ তৎ সৎ বলে ব্যাটা বানিয়েছে ইস্কুল/ও সে, জেতের দফা করলে রফা/মজালে তিন কুল।’’ শত অপমানেও নীরব থেকে তিনি যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন যেদিন সতীদাহর মতো ঘটনা বন্ধ করতে ইংরেজ বিল আনল। সেদিন বহু নারীর কান্না থামিয়ে জয়ের হাসি হেসেছিলেন এই যুগপুরুষ। তিনি ‘রাজা’ রামমোহন রায়। সুদূর ব্রিস্টলে তাঁর মৃত্যুর পর সম্মান জানাতে ভারত সরকার ১৯৬৪ সালে বের করেছিল তাঁর নামাঙ্কিত ডাকটিকিট। পরবর্তীকালে তাঁকে সম্মান জানাতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সুদূর ব্রিস্টলে পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করে সম্মান জানিয়েছিলেন। এক কথায়, বাংলা ও বাঙালির শিক্ষা চেতনায় যে সমস্ত যুগপুরুষ সবকিছুকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শিক্ষার আলোয় সমাজের অন্ধকার ঘোচাতে, তাঁদের মধ্যে রামমোহন ছিলেন অগ্রপথিক। যেন তাঁরই পথে এগিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। নবজাগরণের নবচেতনার অগ্রপথিক বললেও ভুল হয় না রামমোহনকে। বহু উল্লেখযোগ্য বই লিখেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন সম্বাদকৌমুদী নামক পত্রিকা। যার মধ্য দিয়ে তিনি সে সময়ের মানুষকে শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন।

Advertisement

 

Advertisement

Imprint
Responsible for the content:
jibikadishari.co.in
Privacy & Terms of Use:
jibikadishari.co.in
Mobile website via:
WordPress AMP Plugin
Last AMPHTML update:
04.04.2024 - 08:21:58
Privacy-Data & cookie usage: