১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর এক মধ্যরাত্রের বিভীষিকাময় ঘটনা গোটা দেশকে সেদিন স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এক ধাক্কায় মিথাইল আইসোয়ানেট নামক এক গ্যাস দুর্ঘটনায় একটা গোটা নগর মৃত্যুনগরীতে পরিণত হয়েছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রায় চার হাজারের বেশি মানুষ বিষাক্ত গ্যাসে নিরুপায় মৃ্ত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়।। আর তারই আনুষাঙ্গিক ভাবে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন বটে কিন্তু সেই আতঙ্কের ছায়া আজও যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ভোপালের সেই দুর্ঘটনাকে স্মরণ করতেই প্রতি বছর পালিত হয় `ন্যাশনাল পলিউশন কন্ট্রোল দিবস’ (National pollution control day)।
সচেতনতার বার্তা দিতে। এই সচেতনতার মধ্যেও দুবছর আগে বিশাখাপত্তনম ব ভাইজাগে এক বিশাল গ্যাস দুর্ঘঘটনার হাত থেকে হাজার হাজার মানুষ রক্ষা পেয়েছিল। দিনের আলোয় পথ চলতি মানুষ দূষিত গ্যাসের কারণে রাস্তায় লুটিয়ে পডে মারা যান। এই দূষণজনিত মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে না পারলে নিস্তার নেই। দূষণ আজ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে।
শুধু গ্যাস নয়, জলবায়ু থেকে বিভিন্ন দূষণের কারণে মানুষের বিপর্যয় এখন দোরগোড়ায়। পৃথিবীর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্নিত বিশ্বের বিজ্ঞানী থেকে রাষ্ট্র নেতারা। তাঁরা বার বার `লাল সংকেত দিচ্ছেন’। `কানকুন’, কোপেন হেগেন, প্যারিস চুক্তি থেকে সম্প্রতি গ্লাসগো পরিবেশ সম্মেলন- বিশ্বের শয়ে শয়ে বিজ্ঞানী রাষ্ট্রনেতা পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করতে আলোচনায় বসেছিলেন। দূষণমুক্ত করতে সতর্ক বার্তা দিয়ে চলেছেন। বাতাসে ঘুরছে `নেট জিরো’ নামক শব্দ। যার মোদ্দা কথা পৃথিবীকে কার্বনমুক্ত করতে হবে। প্লাসিট মুক্ত করতে হবে। দূষিত কার্বনের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে না পারলে সমূহ বিপদ। আগামী দুদশের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ না করতে পারলে মানুষের চরম বিপর্যয় কেউ রোধ করতে পারবে না। তারই এক ছায়া এখন ভারতেও।
এই দূষণের কারণেই সম্প্রতি দিল্লির স্মস্ত স্কুল কলেজ অফিস কাছারি বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দূষণের কারণে প্রতি বছর শুধুমাত্র ভারতেই ২.৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে। কয়লা. ডিজেল, পেট্রোলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে গোটা বিশ্বে প্রায় ৮ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর মারা যান। এই তথ্য জানাচ্ছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন এর বিজ্ঞানীরা। তাঁদের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমন সব ভয়াবহ তথ্য। জীবাশ্ম জ্বালানি দূষণ আজ বিশ্বব্যাপী। প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যুর কারণ। জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে ভারত ও চিনে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বায়ু দূষণর কারণ চিনে প্রতি বছর ৩.৯১ মিলিয়ন মনুষ মারা যান। ভারতে ২.৪৬ মিলিয়ন। ভারতের চেহারাও ভয়ঙ্কর। ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে যথাক্রমে ৪.৭১ লক্ষ এবং ২.৮৮ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানির কারণেই। এরমধ্যে সবচেয়ে আতঙ্কের খবর ১৪ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যুর সংখ্যাই বেশি।
সবথেকে আতঙ্কের ও বিস্ময়ের তথ্যটি তুলে ধরেছে ল্যান্সের পত্রিকার রিপোর্ট। যেখান বলা হয়েছে দু দশকে ভারতে ১৬.৭ লক্ষ মানুষ শুধুমাত্র বায়ুদূষণে মারা গিয়েছেন। আর দূষণের অকাল মৃত্যর কারণে ভারত তার কোষাগার হারায় প্রতি বছর ২.৭ লক্ষ কোটি টাকা। এবং বায়ু দূষণের ফলে অসুস্থতার কারণে কর্মক্ষম মানুষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে দেশের জিডিপি হারায় ৫৯,১২০ কোটি টাকা।
এইসব ক্ষতি পূরণে দেশের সমস্ত মানুষকেই সজাগ হতে হবে, তা নাহলে সামনে ভয়ঙ্কর দিন। প্লাস্টিক, জল, আলো, বাতাস সবকিছু থেকেই আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে চাই আরও বেশি করে সচেতনতা। কারণ প্রতি বছর উষ্ণায়ন, তাপপ্রবাহ বা শৈতপ্রবাত, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পে ধ্বস্ত পৃথিবীর মূল কারণ দূষণ। লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু মারাই যান না, আর্থিক ক্ষতি হিসাবহীন। খরা বন্যা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হতে পরিয়াযী হতে বাধ্য হন বিভিন্ন দেশে।
দূষণ রোধ করার সচেতনাতা না এলে লক্ষা লক্ষ হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির মতোই আসন্ন বিপদের মুখে মানুষও। যাকে বলা হচ্ছে `ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি’। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বড় সচেতনতার বার্তা। সেই অর্থে ২ ডিসেম্বর তারিখটি ভারতের ইতিহাসে অন্যতম দূষণ সচেতনতার দিন।