রাজা গোপালন বাসুদেবন আর পাঁচজন সাধারণ ছাত্রের মতোই জীবন শুরু করেছিলেন। তামিলনাড়ুর সেই সাধারণ ছাত্রই নাগরিক জীবনে উদ্ভাবন করলেন এমন এক পথ যা শুধু তামিলনাড়ুতেই থেমে থাকল না ছড়িয়ে পড়ল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এই রসায়নবিদের হাত ধরেই পরম শত্রু প্লাস্টিকই আজ নগরায়ণের অন্যতম প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে অনেকেই তাঁর পড়াশোনার ধরন দেখে হেসেছিলেন। কেউ-কেউ তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েননি। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু এই শিক্ষকের মাথায় উদ্ভাবনের পোকা যেন কিলবিল করে। রসায়ন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ও মাস্টার ডিগ্রি করেন যথাক্রমে ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে। পিএইচডি-ও করেন। ১৯৭২ সালে শিক্ষকতা শুরু। রসায়নের ছাত্র পলিটেকনিক কলেজে যখন শিক্ষকতা শুরু করলেন তখনও হেসেছিলেন অনেকে। পলিটেকনিকে শিক্ষকতা করলেও তাঁর মাথায় সব সময় ঘুরপাক খাচ্ছে ‘ডিফারেন্ট’ কিছু করার। শিক্ষকতা চলাকালীনই বিষয় হিসেবে বেছে নেন ‘ওয়েস্ট ম্যানজেমেন্ট’। বিশেষত বর্জ্য প্লাস্টিকই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান বিষয়। চলে নিরন্তর গবেষণা। আর এই বর্জ্য প্লাস্টিককে কাজে লাগিয়েই তিনি উদ্ভাবন করেছেন সড়ক তৈরির মতো প্লাস্টিকের রাস্তা তৈরির প্রধান উপকরণ। সেই প্রচেষ্টারই সুফল মেলে ২০০২ সালে। বিটুমেন ও গ্রাভেলের সঙ্গে ১৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বর্জ্য প্লাস্টিকের সঙ্গে পাথর ও তার দিয়ে তৈরি হল রাস্তা তৈরির উপকরণ। উল্লেখ্য, প্লাস্টিক-তার উভয়েই পেট্রোলিয়াম জাত। ফলে দ্রুত সংমিশ্রণে সুবিধ হয়। এই বিজ্ঞানীই পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম দেখালেন তাঁর কলেজের ক্যাম্পাস তৈরিতে এই পদ্ধতি কত কার্যকর। ক্যাম্পাসের সেই প্লাস্টিকের তৈরি মসৃণ পথ তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। তিনি আরও দেখালেন কত কম খরচে উপযোগী রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। শুধু রাস্তা তৈরিই নয়, সেই রাস্তার আয়ুও দীর্ঘ হবে। দ্রুত ভেঙে বা নষ্ট হয়ে যাবে না। সেই উদ্ভাবন সেখানে শুধু স্বীকৃতিই পেল না, তাঁর আবিষ্কারকে ২০০৬ সালে পেটেন্ট হিসাবেও স্বীকৃতি দেওয়া হল। একদিকে বিজ্ঞানীদের সাধুবাদ অন্যদিকে জাপান-চিনের মতো দেশও সগর্বে বরণ করে নিল এই বিজ্ঞানীর দেখানো আবিষ্কারের পথকে। ভারত সরকার প্রফেসর বাসুদেবনের প্রযুক্তিগত বিদ্যাকে আরও বেশি করে কাজে লাগাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং তামিলনাড়ু সহ ১১ রাজ্যে প্রায় ১০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হল অধ্যাপক বাসুদেবনের উদ্ভাবিত বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে। পরিবেশের এই শক্তিশালী দূষিত বর্জ্যকেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে রাস্তা তৈরির কাজে বাধ্যতামূলক করা হল। ২০১৫ সালে এই পদ্ধতি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠল সব মহলে। উদ্যোগ নেওয়া হল বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাস্তা তৈরিতে এই পদ্ধতি গ্রহণ করার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে ১ টন বর্জ্য প্লাস্টিক ও ৯ টন বিটুমেনের মিশ্রণ দরকার হয়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করি সেই ১০ লাখ ক্যারিব্যাগ থেকে ১ টন বর্জ্য প্লাস্টিক পাওয়া যায়। বর্তমানে যেভাবে নগরায়ণ ঘটছে এবং রাস্তার আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা থেকে আগামী দিনে এই পদ্ধতিতে রাস্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনেকগুণ বাড়বে। প্লাস্টিক ও পাথরের এই মিশ্রিত উপকরণের নাম `প্লাস্টোন’। একদিকে যখন প্লাস্টিককে পৃথিবীর দূষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে অন্যদিকে তেমনই প্লাস্টিকের রমরমা বৃদ্ধি। প্লাস্টিক ছাড়া অচল গরিব-বড়লোক সবাই। বিশেষ করে গরিব মানুষের বন্ধু এবং শত্রু উভয় রূপেই চিহ্নিত হয়ে উঠছে দিন-দিন। গ্রামে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এই প্লাস্টিকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। শহর ও গ্রাম উভয়ই প্লাস্টিকের মাদুর, চেয়ার, টেবিল, দুধের প্যাকেট, আলমারি, ব্যাগ, খেলনা থেকে শুরু করে মাথার ছাদেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে তখন পৃথিবীর দূষণও ততোধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে এই উপকরণটির জন্য। পরিবেশ দূষণ পর্ষদের এক রিপোর্ট জানাচ্ছে প্রতিদিন ১৫,৩৪২ টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে পরিণত হয়, বছরে সেই পরিমাণ প্রায় ৫.৬ মিলিয়ন টনেরও বেশি। প্রতিদিন কয়েকলক্ষ টন প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নালা নর্দমা পুকুর থেকে সমুদ্র দূষণ পর্যন্ত ঘটিয়ে ক্রমশই ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। ‘নিষিদ্ধ’ আখ্যা দিয়েও রোখা অসম্ভব হয়ে উঠছে, তখন অধ্যাপক বাসুদেবনের এই আবিষ্কার একদিকে আশীর্বাদের মতো যেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘বেটার মেথড, টু ডিসপোজ ইট’। তাঁরই দেখানো পথে আজ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কম খরচে পৃথিবীর অন্যতম দূষণ সামগ্রীকে কাজে লাগিয়ে রাস্তা তৈরি হচ্ছে এবং তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিকের দূষিত দিককে হারিয়ে বাসুদেবন আজ সারা বিশ্বেই হয়ে উঠেছেন ‘প্লাস্টিক ম্যান’। এই নতুন পথ দেখিয়ে উদ্ভাবনী শক্তির জন্য বাসুদেবন ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছেন। শুধু এই সম্মানই নয়, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নামাঙ্কিত এপিজে কলাম মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড সহ বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই ‘ডিফারেন্ট’ ভাবনার মানুষটি। তাঁর আবিষ্কৃত পথেই মেঘালয়ের মতো বৃষ্টিবহুল রাজ্যে তৈরি হয়েছে এবং হতে চলেছে কয়েক কিলোমিটারের প্লাস্টিক পথ। যা অতি বর্ষণেও দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে না। পরিবেশের শত্রু বর্জ্যকেই পুনর্ব্যবহার করার আবিষ্কারে নগরায়ণ গড়ে তোলার পথ তৈরি করতে তামিলনাড়ুর এই বিজ্ঞানী রাজা গোপালন বাসুদেবনের দেখানো পথই মানুষের নতুন সড়ক উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
ভাস্কর ভট্টাচার্য