জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন সব ক্ষেত্রেই। কখনও-কখনও মত ও পথের বিভাজনও যে হয়নি তা নয়। তবু সত্যের সন্ধানে আজীবন পথ হেঁটেছেন। জীবনের একটাই ব্রত ছিল `সত্য’। সেই সত্যের সন্ধানে জীবন ও জাতিকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। আর জাতিও সেই পথে তাঁকে পেয়েছে অনেকটাই। শুধু স্বদেশেই নয় পূজ্য হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্বের নানা দেশে।তাঁর মত ও পথকে অনুসরণ করতে দ্বিধা করেননি মার্টিন লুথার কিং থেকে রোমঁ রোলঁ, আইনস্টাইন থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ ঘটলেও তাঁর বিশ্বভারতী গড়ার ক্ষেত্রে পাশে পেয়েছিলেন রাজনীতির এই মহান মানুষটিকে। কখনও দারিদ্র্য নিপীড়নে পথে নেমেছেন তো কখনও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি অভিযান করেছেন। অহিংসা ছিল জীবনের ব্রত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসহযোগ আন্দোলনে প্রথমে সায় থাকলেও পরবর্তীকালে তার ভয়াবহ চেহারা দেখে সেই পথ পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা করেননি।
গুজরাটের পোরবন্দর নামক স্থানে ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ এবং সেখানে বড় হয়ে ওঠা তারপর আইন পড়তে লন্ডনে যান। লন্ডনের পাট চুকিয়ে ফিরে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার পথে। সেই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বিদ্বেষ-এর ঘৃণা ও অপমান তাঁকে আইনের পথ থেকে রাজনীতির পথে নিয়ে এসেছিল। ব্যারিস্টার গান্ধী ঢাকা পড়ে গেলেন স্বদেশি গান্ধীর আড়ালে। দক্ষিণ আফ্রিকার গণ আন্দোলন দিয়ে শুরু।১৮৯৪ সালে নাটাল ইন্ডিয়া কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।তারপর ক্রমশই নিজেকে যুক্ত করেন নানান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। দেশে ফিরে ১৯১৮ সালে সক্রিয় ভাবে চম্পারণ বিক্ষোভ ও সত্যাগ্রহে অংশ গ্রহণ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। অসহযোগ আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা। বিদেশি দ্রব্য বর্জন অর্থাৎ বিদেশি পোশাকের বদলে স্বদেশি পোশাক এবং চরকা কেটে খাদি পোশাকের প্রতি সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। যার জন্যই গড়ে উঠেছিল খাদি কমিশন। আমাদের প্রথম দিকে চরকা হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রতীকের মতো। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী সম্পাদক। রাজনৈতিক কারণে ১৯২১ গ্রেপ্তার হন ও দু বছর জেল খাটতে হয়। জীবনে বাইরে যতদিন ছিলেন জেলেও কম দিন কাটাতে হয়নি। সারা বিশ্বে তিনি `মহাত্মা’ বা ‘বাপু নামে’ পরিচিত। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে তাঁর স্মৃতি বা তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় না। রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও বিরোধীদের সম্মান কখনও-কখনও আদায় করে নিয়েছেন যদিও তাঁর মৃত্যু এক চরম লজ্জা। হিন্দু-মুসলমান মৈত্রী স্থাপনেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নোয়াখালি দাঙ্গা রোধে প্রায় চার মাস সেখানে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলে।তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে `জাতির জনক‘ আখ্যা দিয়েছিল ভারত সরকার। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতি সংঘ তাঁর ২ অক্টোবর জন্মদিনটিকে ’অহিংসা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।সারা জীবন নিরামিষাশী ছিলেন।আট হাতি ধুতি এবং হাতে লাঠি নেওয়া অবয়বটি সারা বিশ্বের কাছে এক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। চার খণ্ডে যেমন লিখে গেছেন তাঁর আত্মচরিত, তেমনই বিশ্বের বহু দেশ বহু মনীষী বহু গবেষক তাঁকে নিয়ে আজও গবেষণামূলক লেখা লিখে চলেছেন। তৈরি হয়েছে সিনেমা থেকে নাটক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত `হরিজন’ পত্রিকা সে সময়ে আলোড়ন তুলেছিল। নিম্নবর্গের হতদরিদ্র মানুষের জন্য আজীবন অশ্রু বর্ষণ করে গেছেন। এ বছর সেই মহান মানুষটিরই সার্ধশত বৎসর। দেশে-বিদেশে সম্মান ও শ্রদ্ধায় চলবে তাঁর স্মরণ।