যে কোনো রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করে তোলার প্রধান উপাদানই হল সেই দেশের উন্নত কৃষি ব্যবস্থা। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার বা অনেক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একাধিক নীতি গ্রহণ করে।
সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল অ্যাক্ট (Indian Agricultural Act, 2020) নিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চর্চা শুরু হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখ লোকসভায়, ও ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় বিলটি পাশ হয়। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে বিলটিতে সম্মতি প্রদান করেন।
২০২০ সালের এই বিল অনুযায়ী তিনটি ক্ষেত্রে সংশোধনী আনতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১) Farmer’s Produce Trade & Commerce (Promotion & Facilitation Act) 2020 যার লক্ষ্যমাত্রা কৃষিজ পণ্য রাজ্যের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তঃ রাজ্য বাজার থেকে বিস্তৃতি বাড়িয়ে দেশের যে–কোনো প্রান্তে বিক্রয় বা ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া। সমস্ত সরকারি মান্ডিসমূহের নিয়ন্ত্রণ বা বাধ্যবাধকতা কমিয়ে আনা। কৃষিজ পণ্যকে ইলেক্ট্রা-ট্রেডিং বা অনলাইন ট্রেডিং-এ শামিল করা।
২) Farmers (Empowerment & Protection) Agreement of Price Assurance and Farm Service Act, 2020 যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি, পার্টনারশিপ ফার্ম, গ্রুপ যে-কোনও চাষিদের সঙ্গে চুক্তি চাষে আবদ্ধ হতে পারবেন। চাষি এবং “স্পন্সর”দের মধ্যে বিশেষত কৃষজ পণ্যের গুণগত মান, বিতরণ, দাম, কৃষি পরিষেবা ফার্মিং নিয়ে পারস্পরিক চুক্তি হবে। চাষি এবং স্পন্সরের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে চুক্তি তৈরি হবে। চাষের আবহাওয়া ও অবস্থার ওপর ভিত্তি করে চুক্তি বার্ষিক থেকে শুরু করে পঞ্চবার্ষিকী হতে পারে। এখানে কোনও সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্য (Minimum Support Price) থাকছে না।
৩) ১৯৫৫ সালে খাদ্য সংকট বা অন্যান্য জরুরি সমস্যার কথা মাথায় রেখে তৈরি হয় “Essential Commodities Act”। বর্তমান আইন অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে আলু, পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ ইত্যাদি কিছু বাদ রাখা হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে (যুদ্ধ, মহামারী বা অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি) কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট কোনো পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ঘটাবে। অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির মাপকাঠি হবে কোনও সাধারণ পণ্যের বা শস্যের ১০০% মূল্য বৃদ্ধি হলে এবং পচনশীল পণ্য বা শস্যের ৫০% মূল্যবৃদ্ধি হলে। মূলত কৃষিজ পণ্য বেআইনিভাবে গুদামজাত করে রাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এই আইন বলে দাবি করা হচ্ছে।
নতুন বিলের প্রতিবাদে বেশ কিছু কৃষক সংগঠন ও সমিতি লাগাতার প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেন সেপ্টেম্বর মাস থেকে। নভেম্বরের শেষ দিক থেকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা প্রদেশের বিশাল সংখ্যক কৃষক দিল্লিতে ধর্না আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ থেকেও কৃষকরা আন্দলেনে শামিল হন। স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাসে অন্যতম বড় কৃষক আন্দোলনের আকার ধারণ করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। সম্মুক্ত কিষান মোর্চা এবং অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটির উদ্যোগে প্রায় ২২-২৫টি সংগঠনের কৃষকরা আন্দোলনের জন্য জড়ো হন দিল্লির সিংঘু বর্ডার, কুন্ডলি বর্ডার, ধনসা বর্ডার, ঝড়োদা বর্ডার, বাহাদুরগড় ও ফরিদাবাদ বর্ডারে। কৃষি বিলের এই নতুন সংশোধনীতে বিরোধিতা করে কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষক সমাজের এক বিরাট অংশ। যোগ দিয়েছেন কৃষকরমণীরাও। ইতিমধ্যে আন্দোলনরত অবস্থায় মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন। ভারতীয় কৃষক ইউনিয়নের দাবি, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৬০ জন কৃষক এই আন্দোলনের মধ্যে মারা গেছেন। অন্যদিকে, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ বিহার, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, কেৱল, তেলেঙ্গানা থেকে ১০টি কৃষক সংগঠন এই নতুন আইনের সমর্থন জানায়। দাবি, ২৪ ডিসেম্বর, প্রায় ২০ হাজার সমর্থক দিল্লি পর্যন্ত মার্চ করেন আইনের সমর্থনে।
আন্দোনল চলাকালীন প্রচুর পিটিশন দাখিল হতে থাকে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে। ১২ জানুয়ারি, ২০২১ সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের ওপর স্থগিতাদেশ জারির পরামর্শ দেয় সরকারকে। একটি কমিটি তৈরির নির্দেশ দেয় আন্দোলনরত কৃষক ও সরকার উভয় পক্ষের বক্তব্য খতিয়ে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কিন্তু এখানেও কমিটির প্রস্তাবিত সদস্যদের ওপর আস্থা নেই আন্দোলনকারীদের। মীমাংসাসূত্রের জন্য চলে আন্দোলনকারী ও সরকারি পক্ষের মধ্যে কয়েকদফা আলোচনা। সরকার তিনটি দাবি মেনে নিতে রাজি হয় কিন্তু আইন প্রত্যাহারের দাবিতে নারাজ, যদিও সংশোধন প্রস্তাব চাওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড়। অতঃপর সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয় আগামী দেড়বছর আইন বলবৎ হবে না, স্থগিত থাকবে। আন্দোলন অব্যাহত।
ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:
১) স্বাধীনতার পর থেকেই মূলত চাষযোগ্য ভূমি বাড়ানো অর্থাৎ কৃষিজ জমির বিস্ততারের কাজ শুরু হয়। ৬০ সালের পরবর্তীকালে কৃষি ব্যবস্থার সুষম বণ্টন ও উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে জোর দেওয়া শুরু হতে থাকে দেশে। ১৯৬৫ সালে মূলত চাল ও গমের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয় ফুড কর্পোরেশ অব ইন্ডিয়া। এর সঙ্গে মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত হয় এগ্রিকালচারাল প্রাইসেস কমিশন যার পরবর্তী নাম কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেস।
২) কৃষক গোষ্ঠীকে আরো চাঙ্গা করে তুলতে প্রয়োজন হয়ে পরে কৃষি ঋণ ব্যবস্থার। ১৯৮২ সালে তৈরি করা হয় ন্যাশনাল ব্যাংক ফর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট (NABARD ) এবং অন্যান্য রুরাল রিজিয়নাল ব্যাংক। ১৯৫০ সালের পর থেকেই প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি ও সুষম বণ্টনের জন্য নীতি রূপায়নণ করা হয়ে থাকে।
৩) কেন্দ্রীয় সরকারের Ministry of Agriculture (২০১৫ থেকে Ministry of Agriculture & Farmers Welfare)-এর অধীনে রয়েছে Department of Agriculture, Co-Operation & Farmers’ Welfare যার অধীনে মোট ২৭টি ডিভিশন রয়েছে। যারা রাজ্য সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কৃষি নীতি রূপায়ণে সচেষ্ট থাকে।
৪) ১৯২৯ সালে ভারতে তৈরি হয় “Indian Council for Agricultural Research”. কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অটোনোমাস বডি যারা মূলত এগ্রিকালচারাল কলেজ ও ইউনিভার্সিটিটির অনুমোদন প্রদান করে থাকে।
৫) ১৯৬৪-৬৬ সালে দেশ যে খাদ্য সংকটের মধ্যে পরে বা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়, তারপর থেকেই উন্নত উৎপাদন, আধুনিক সরঞ্জাম, উন্নতমানের বীজ রোপণ, উৎকৃষ্ট শস্য চাষের ওপর জোর দেওয়া হয়। যার ফলস্বরূপ তৎকালীন সরকার “Green Revolution”-এর কর্মসূচি নেয়। প্রথমে অন্তর্জাতিক স্তরে নোবেলজয়ী অধ্যাপক নরম্যান আর্নেস্ট বোর্লগ ও ভারতের ক্ষেত্রে প্রধান হোতা ডঃ এম এস স্বামীনাথন। ১৯৬৬ সালের সবুজ বিপ্লবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ এই তিনটি রাজ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬) এরপরেও অপারেশন ফ্লাড (দুধ উৎপাদন) ১৯৭০-১৯৯৬, হলুদ বিপ্লব (তৈলবীজ উৎপাদন) ১৯৮৬-৯০ এবং নীল বিপ্লব (মৎস উৎপাদন) ১৯৭৩-২০০২ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
৭) গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্সে ১১৩টি দেশের মধ্যে ভারত বর্তমানে ৭২তম স্থানে রয়েছে।
৮) ন্যশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে মোট ১০,২৮১ জন কৃষক বা কৃষিকাজে যুক্ত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, যা মোট আত্মহত্যার ৭.৪% ।
আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল : ক্লিক করুন
Farm Bill 2020, Farmers Agitation, Agriculture Bill 2020, Indian Agricultural Act, 2020