বিশ্ব সাইকেল দিবস : সাইকেল নিয়ে নানা কথা

4906
0
Bye Cycle

ডাক নামে কেউ-কেউ বলত ‘শখ–ঘোড়া’ বা ‘বেলে ঘোড়া’। এই নাম শুনলে একালের অনেকেই একটু ঘাবড়ে যাবেন। কিন্তু সেকালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী আগে আজকের সাইকেলকেই ডাকা হত শখ-ঘোড়া নামে। কেউ-কেউ মানবচালিত মেশিনও বলত। কারণ চাকা থাকলেও আকার ও আয়তন ছিল অনেক বড় এবং তা মেশিনের সাহায্যে চালাতে হত।

সে এক মর্মান্তিক ঘটনা। হঠাৎ আগ্নেয়গিরির কবলে গোটা মাঠের ফসল তো পুড়ে গেলই সেই সঙ্গে বেশ কিছু ঘোড়াও আগ্নেয়গিরির আগুনে মারা গেল। সেই দিন থেকেই শুরু। ফসলের মাঠের বিস্তৃত এলাকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত যাবার ভাবনাচিন্তা শুরু। জার্মানির এক সিভিল সার্জন ব্যারন কার্ল ফন ড্রেসের-এর মাথা থেকে বেরল এক নতুন ধরনের যান। এবং সেই যান পেটেন্টও নিলেন তিনি। কখনও দু চাকা, কখনও তিনচাকা প্রভৃতি রূপ পালটে ছড়িয়ে পড়ল জার্মানি ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে। লন্ডনের ডেনিস জনসন নামক এক উৎসাহী ১৮১৮ সালে তৈরি করলেন আরেক ধরনের যান। যা দুচাকায় চলে। ক্রমশই এই যানটি বিভিন্ন প্রান্তে শুধু উৎসাহ নয়, প্রবল উদ্দীপনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল কাজের সুবিধায়। একদিকে জনপ্রিয়তা অন্যদিকে তার রূপ পরিবর্তন হয়ে কী করে আরও সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে সেই ভাবনা। আমরা বর্তমান যুগের আধুনিক সাইকেলের অতীত দিকে তাকালে দেখতে পাব এই দুশো বছরে তার অবয়ব বা রূপ পরিবর্তন হয়েছে প্রায় দুশোবারেরও বেশি। এক অর্থে ১৮৬০ থেকে ১৮৮০ ছিল বাইসাইকেলের বিবর্তনের গতি। দু চাকার পিঠে ভর করে দ্রুত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে কাজে-কর্মে চলে যাওয়া যায়। শুধু কি পুরুষের উপযোগী? নারীদের উপযোগী সাইকেলও বেরিয়েছে। সেদিন নারীদের উপযোগী সাইকেল নিয়ে কম আলোড়ন হয়নি গোটা দুনিয়ায়। ফেমিনিজম অ্যান্ড সাইকেল। সাইকেল নিয়ে বিজ্ঞানী-ডাক্তার মহলে হইচই। সব প্রতিরোধকে ডিঙিয়ে দু চাকার সাইকেল গোটা বিশ্বে স্থান করে নেয়। সাইকেলে চড়তে গেলে নাকি স্কার্টের বাধায় মেয়েদের অসুবিধে। তৈরি হল মেয়েদের উপযোগী সাইকেল। মাঠের ফসল দেখাশোনার থেকে যুদ্ধের কাজেও সেদিন সাইকেল এক অনন্য ভূমিকা নিয়েছিল। এই সাইকেলের উন্মাদনাতেই সেদিন ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট এলিজাবেথ উইলিয়ার্ড গড়ে তুললেন ‘উওমেন ক্রিশ্চিয়ানস’ টেম্পারেন্স ইউনিয়ন’ (WCTU)। তিনি লিখেছিলেন ‘এ ওম্যান রাইডস অন এ হুইল’। নারীশক্তির বহিঃপ্রকাশ সেদিন ছিল সাইকেল। আর এই সাইকেলের কথা বললেই উঠে আসে পৃথিবীখ্যাত আয়ারল্যান্ডের লেখিকা বিয়াত্রিচ গ্রিমশ (Beatric Grimshaw)-র কথা। ১৮৭০ সালে জন্মানো এই লেখিকা প্রথম জীবনে সাইকেলে চড়েই কলেজে গেছেন। সেই সাইকেলই তাঁকে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সাংবাদিকতার পেশায় নিয়ে এসেছিল। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা থেকে বিশ্বের নামী কাগজের সম্পাদক এবং মালিকও হয়েছিলেন। সেই নারী সম্পাদক-লেখিকার উত্থানের সে আরেক রোমাঞ্চকর কাহিনি।

এই সাইকেল উন্মাদনার দিনেই সেদিন ইংল্যান্ড থেকে খবর এল তিন বাঙালি সন্তানের কথা। যাঁরা ইংল্যান্ডের পথে সাইকেল চালানোয় হাত পাকাচ্ছেন। তখন ইংল্যান্ড তাঁদের ঠিকমতো চিনে উঠতে পারেনি। পরবর্তীকালে তিন জনেই পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এই তিনজন হলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় আর স্বামী বিবেকানন্দ। সঙ্গে জগদীশঘরণী লেডি অবলা বসু। ইংল্যান্ডের পথে সাইকেল চালিয়ে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৮৯৬ সালে এপ্রিলের শেষে স্বামীজি ইংল্যান্ডে সাইকেল চড়া অভ্যেস করেন। সেখানেই নরেন্দ্রনাথ একদিন সারদানন্দ ও ভাই মহেন্দ্রনাথকে বললেন, ‘চ সকলে মিলে সাইকেল চড়ি।’ তাঁদের সেই সাইকেল চালানোর কথা পাই উনিশ শতকের কলকাতাতেও। জগদীশচন্দ্র চন্দননগর ছেড়ে কলকাতার মেছুয়ায় থাকাকালীন খুব ভোরে উঠে সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন গড়ের মাঠে। সঙ্গে থাকত ভগ্নিপতি আনন্দমোহন বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র হেমেন্দ্রমোহন বসু। এই হেমেন্দ্রমোহনই প্রথম কলকাতায় সাইকেলের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

অনেক যুদ্ধ, অনেক পাহাড়পথ পেরিয়ে আজ সাইকেল অন্যতম পরিবেষদূষণমুক্ত যান হিসেবে চিহ্নিত। সাইকেল ধনী-গরিবের যান। সহজ সাশ্রয়ী পরিবেশনির্ভর যান হিসেবে আজ সর্বজনস্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। এক কথায়, সাইকেল মানব জাতির অগ্রগতির প্রতীক। দুই শতাব্দী ধরে তার জনপ্রিয়তা। এই মুহূ্র্তে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ প্রতিদিন সাইকেলে যাতায়াত করে কাজকর্ম করেন সারা বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রফেসর লেসেভ সিবিলস্কি প্রথম এই সাইকেলযানটিকে স্মরণে রেখেই বিশ্বসাইকেল দিবস হিসেবে তকমা দিতে দাবি তোলেন। তুর্কমেনিস্তান সহ ৫৬টি দেশ তাতে সম্মতি জানায়। সাইকে্লের নানাবিধ সুবিধার কথা তুলে ধরা হয়। আর তারই স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই যানটিকে ২০১৮ সালে প্রথম ৩ জুন তারিখটিকে বিশ্ব সাইকেল দিব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ বছর ৩ জুন দ্বিতীয় সাইকেল দিবস।

এই গতির যুগে এসেও সাইকেলকে কেউ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। আর একজন ভ্রামণিকের কাছে সাইকেল যে কত মূল্যবান তার অনেক কাহিনি বর্ণিত আছে অভিজ্ঞতালব্ধ বইয়ের পাতায়। দু চাকায় সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়ে তারই স্মৃতিকথা মূলক ‘দু চাকায় দুনিয়া’ নামক একটি বইও লিখেছিলেন সেই ভ্রামণিক। সাইকেলে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বেড়ানোর কথাও জানা যায়।