মারণ রোগের প্রতিকারে ভ্যাকসিনের পথচলা : সংবাদ দিশারী

876
0

এমনই একটা দিনের অপেক্ষায় ছিল গোটা মানব বিশ্ব। বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যুর দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ভ্যাকসিনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে জয়ী হল বিজ্ঞানই। সেই জয়ই দেখল আবিশ্ব মানুষ। ভাইরাস বিজ্ঞানীদের হাত ধরে এল `কোভিড ১৯’ ভ্যাকসিন। কিছুটা হলেও স্বস্তির শ্বাস নিতে পারল গোটা বিশ্বের মানুষ। আশার আশ্বাসবাণী দিয়েই এসে গেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন।
লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে জয় এল বিজ্ঞানের হাত ধরে। একদিকে অসহায় চিকিৎসাহীন মৃত্যু অন্যদিকে বিজ্ঞানী ডাক্তার থেকে স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরন্তর প্রাণ বাঁচানোর লড়াই ভ্যাকসিনের ইতিহাস স্মরণ রাখবে। যেমনভাবে ইতিহাস হয়ে আছে স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত, প্লেগ থেকে ইদানীং কালের বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস।
যদিও বিশ্বের বহু প্রান্তে এখনও বহু মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বা মারা যাচ্ছেন, কোথাও-কোথাও তবু সেই পরিস্থিতির মধ্যেই এল করোনা ভ্যাকসিন। সেই অর্থে বিশ্ব ক্যালেন্ডারে ২০২০ সাল যদি নিঃশব্ধ প্রাণঘাতী অভিশপ্ত বছর হয়ে থাকে মানব জীবনে, তাহলে অবশ্যই ২০২১ সালের সূচনা হল এক জয়ের স্বপ্ন নিয়ে। বিশ্বে সেই জয়ের শামিল আমাদের দেশ ভারতও। জয় এখনও বলা যাবে না, তবু জয়ের সূচনা বলা যেতেই পারে। কারণ এরই মধ্যে এসেছে আবার নতুন ভাইরাস। যা নাকি আরও শক্তিশালী যা ব্রিটেন `স্ট্রেন’ বলেও পরিচিত। এখনও পর্যন্ত নাকি হাজার খানেক বৈচিত্র্যময় `স্ট্রেন’এর সন্ধান মিলেছে।

এরই মধ্যেই অক্সফোর্ড ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া-র সহযোগিতাতেই ভারতেই তৈরি করোনা ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড দিয়ে শুরু হল ভারতে করোনা ভ্যাকসিনের সূচনা। দেশে সর্বপ্রথম টিকা দেওয়া হল মণীশকুমার নামে এক ব্যক্তিকে। ৩৪ বছরের এই ব্যক্তি বিখ্যাত এইমসের একজন সাফাই কর্মী। কলকাতায় প্রথম ভ্যাকসিন নিলেন অনুপম দাস নামে এক ব্যক্তি। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেলে সারা দেশে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়া।
শুধু ভারতবর্ষ নয়, ভারতবর্ষের মাটি ছুঁয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশেও ভারতের কাছ থেকে প্রথম দফায় কয়েক লক্ষ ভ্যাকসিন পাঠানো হল সে দেশের মানুষদের জন্য।
বিশ্বে করোনা ভ্যাকসিনের ইতিহাসে ভারত নাম লেখাল ১৬ জানুয়ারি ২০২১। সারা দেশ জুড়েই বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ-লক্ষ মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগের সূচনা হল। সেই অর্থে ২০২১ করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯ যুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় তারিখ হয়ে থাকল। যদিও রাশিয়া, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরির যু্দ্ধে শামিল। কোথাও-কোথাও প্রয়োগ শুরুও হয়ে গেছে।
বিশ্ব প্রথম করোনা ভাইরাসের সংবাদ মিলেছিল চিনের উহান শহরে ২০১৯ এর ডিসেম্বরে। তা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই তারপর গোটা বিশ্বেই করোনা ভাইরাস হুহু করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চিন, জাপান, আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশে। কয়েক কোটিরও অধিক  মানুষ (২০,৪৩,৭২৮ এ পর্যন্ত) শুধুমাত্র এই ভাইরাসের কারণেই অসহায় ভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর পর ভাইরাসজনিত কারণে এত বড় প্রাণহানি নাকি হয়নি। সেই তালিকায় সব থেকে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন ব্রিটেন ও আমেরিকায়। তারপর ইতালি সহ বিভিন্ন দেশে।
ভাইরাসের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে গোটা বিশ্ব একসময় লকডাউন বা মানুষের গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছে। কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছেন সারা বিশ্বে। সমস্ত স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল, ট্রেন বাস, বিমান এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। এই অবরুদ্ধ জীবনে অনেক নতুন-নতুন শব্দ সৃষ্টি বা পরিচিতি ঘটেছে। সেই পথ ধরেই এল ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন কী? তার একটাই উত্তর, শত্রু দিয়েই শত্রু মারা। পশু বা মানব শরীরে যে প্রাণঘাতী শত্রু ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশ করে প্রাণহানি ঘটায়, সেই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্যেই ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি প্রস্তুতকারী ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে শত্রু ভাইরাসকে দমন করানোই প্রধান কাজ ভ্যাকসিনের।
  • ভ্যাকসিন শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় আজকের নয়, কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই।
  • আর আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে প্রথম ভ্যাকসিনের জনক হিসেবে যিনি পরিচিত হয়ে আছেন তিনি একজন ইংরেজ শিক্ষক ও বিজ্ঞানী ডাঃ এডোয়ার্ড জেনার। ১৭৯৬ সালে (বিতর্কে ৯৮) তাঁকেই ভ্যাকসিনের পথিকৃৎ হিসেবে মানা হয়। যেটি পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন।
  • গরুর শরীর থেকে সৃষ্ট রোগ মানব শরীরে প্রবেশ করে প্রাণহানি ঘটাত। তখন তা ছিল অজানা। সেই অজানারই প্রথম সন্ধান দিয়েছিলেন ডাঃ জেনার। যিনি গুটি বসন্ত বা স্মল পক্সের ভ্যাকসিন সৃষ্টি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এবং তিনি কোকিলের পরজীবীতা আলোকপাত করেছিলেন।
  • ডাঃ জেনারকে রোগ প্রতিরোধ বিদ্যার `জনক’ বলা হলেও প্রথম ভ্যাকসিনের আবিষ্কারের যাত্রাপথে জড়িয়ে আছে এক নারীর নাম তিনি লেডি মারি ওরতলি মন্তাগু। তাঁর উদ্যোগকেও ভ্যাকসিনের ইতিহাসে প্রারম্ভকালে ভোলা যাবে না। তারপর একে-একে এসেছে জলাতঙ্কের টিকার জনক লুই পাস্তুর সহ অনেক বিজ্ঞানী।
ভ্যাকসিনের তালিকায় স্মরণীয় উনিশ শতকের টাইফয়েড, কলেরা, প্লেগ, টিউবারকিউলোসিস, ইয়েলো ফিভার, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও, হেপাটাইটিস, জাপানি এনসেফালাইটিস, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়াজাত অসুখ ও তার ভ্যাকসিন। নানা রোগ প্রতিরোধ গড়তে শিশুবয়স থকেই নানা ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়েই আমাদের বড় হয়ে ওঠা। সেই তালিকায় এল কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন।
আর এখানেই বলার, পেরিয়ে আসা ভয়াবহ রোগের মতোই অনেক রোগকেই প্রতিহত করে বিজ্ঞান এগিয়েছে। হয়তো সেদিন আর বেশি দূর নেই যেদিন কয়েকশো ভাইরাসের মতো করোনা ভাইরাসকেও বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে দমিয়ে দিতে পারবেন। আর হয়তো নানান কোম্পানির ভ্যাকসিন নিয়েই একদিন দেখা যাবে প্রাণ বাঁচানোর `ভ্যাকসিন যুদ্ধ’।

ভাস্কর ভট্টাচার্য

শুরু হল আমাদের নতুন বিভাগ  “সংবাদ দিশারী,” পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক সংবাদ তুলে ধরা হবে  এই বিভাগে।