ডায়েরি কথা

schedule
2021-01-06 | 06:53h
update
2021-01-06 | 11:12h
person
জীবিকা দিশারী
domain
জীবিকা দিশারী
Anne Frank

যে-কোনো চলে যাওয়াতেই মন খারাপ থাকে, থাকে স্মৃতির ছোঁয়া, সেই স্পর্শ নিয়ে চলে গেল একটা বছর। এক ঐতিহাসিক বছর। সারা পৃথিবীর কাছে।স্প্যানিশ ফ্লুর একশো বছর পর এমন একটা প্রাণঘাতী বছর এসেছিল কোভিড ১৯ বা করোনার মতো হাওয়ায় ভাসা এক আক্ষরিক অর্থেই সর্বনেশে ভাইরাস নিয়ে।যার ছোবলে পৃথিবীর বুক থেকে এ পর্যন্ত এক কোটিরও অধিক মানুষ অকালে চলে গেছেন। লক্ষ-লক্ষ মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছেন, কর্মচ্যুত হয়েছেন সারা বিশ্ব জুড়েই।

এ সময়ের ইতিহাস নানা নথির সঙ্গে-সঙ্গে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে কারও-কারও ডায়েরিতেও নিশ্চয়ই। আরও কতরকমে ক্ষতি হবে কেউ জানেন না। বছর গেলেও ভাইরাস নির্মূল হয়নি এখনও, কত মানুষকে কত প্রিয়জন এখনো হারাতে হবে, তা ভাইরাসই বলতে পারবে। সীমাহীন লড়াই। এরই মধ্যে বিদায় নিতে-নিতে এই বছর এও জানিয়ে দিয়ে গেল ভ্যাকসিন এসে গেছে। ট্রায়াল চলছে। আশার বাণী নিয়েই এল একুশ।

কুড়ি বিদায়, স্বাগত একুশ। মনে পড়ছে নতুন বছর মানেই ক্যালেন্ডার আর ডায়েরির আগমন। এ বছর তাতেও একটু ছেদ ঘটেছে। অথচ নতুন বছরের সূচনায় এই ডায়েরি ক্যালেন্ডারই যেন নতুন বছরের আগমন বার্তা দিত। নতুন বছরের সেইসব দিন। অসংখ্য রকমের ক্যালেন্ডার, নতুন বছরের গ্রিটিংস কার্ডের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়েই তৈরি হত সম্পর্কের বাঁধন। অফিস-কাছারি থেকে শুরু করে প্রণয়ের বিনিময় হয়ে থাকে গ্রিটিংস কার্ড বা ডায়েরি দিয়েই।

ডায়েরি লেখার অভ্যাস এক ভয়ানক নেশা। কত ফেলে আসা  দিন-ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখা। কত অফিশিয়াল এনগেজমেন্ট,  নথি লিপিবদ্ধ করার অন্যতম জরুরি মাধ্যম ছিল ডায়েরি। এখন মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার সেখানেও থাবা বসিয়েছে।

ডায়েরির বিশাল জগৎ। কত গোপন কথা, কত সুখের কথা , কত যন্ত্রণার কথা, যুদ্ধের দিনলিপির কথা থেকে শুরু করে রহস্য রোমাঞ্চের কত কাহিনি রচিত হয়েছে ডায়েরির রচনায়। ডায়েরি বলতেই আমাদের প্রথমেই মনে পড়ে কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কথা। জানা যায় বিশ্বের সব থেকে বেশি বিক্রীত বাইবেলের পরই রয়েছে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি নাকি বেশি পঠিত। পৃথিবীর ৬৭টি ভাষায় ৩ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রীত আজও। আজও স্কুলপাঠ্যও বটে। এই ডায়েরিতেই তো‌ কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক লিখেছিলেন জার্মানির সেই নৃশংস কালোদিনের পৃথিবীখ্যাত ঘটনার কাহিনি। আর রবীন্দ্র সাহিত্যের একটা বড় অংশই ডায়েরি। তা সে `জাপান যাত্রীর ডায়েরি’ই হোক, `ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ বা `রাশিয়ার  চিঠি’।

Advertisement

পৃথিবীর  অসংখ্য গুণী মানুষই ডায়েরি লিখেছেন। তা সাহিত্যিকিই হোন, বিজ্ঞানীই হোন বা রাষ্ট্রনেতাই হোন। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগন হোয়াইট হাউসে যত দিন ছিলেন ততদিন নানা কাজের ফাঁকে রোজ নিয়ম করে ডায়েরি লিখতেন। চার্লস ডারউইন ২৯ বছর বয়সে ডায়েরি লেখা শুরু করে ১৮৮১ সালে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। তাঁর যাবতীয় বিবর্তনবাদের গবেষণা লিপিবদ্ধ করতেন ডায়েরিতে। প্যারাপাগুস দ্বীপপুঞ্জে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন হাতে ডায়েরি নিয়ে। বিবর্তনবাদের নানান তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর প্রিয় ডায়েরিতে।

আর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রসায়নবিদ এবং পদার্থবিদ মারি কুরির ডায়েরির কথা তো বিশ্ববিদিত। মারি কুরির গবেষণার ডায়েরিটি একটি সিসের বাক্সে তেজস্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে আজও সংরক্ষিত। কেউ তাঁর ডায়েরি দেখতে ইচ্ছুক হলে সুরক্ষামূলক পোশাক পরিধান করেই দেখার অনুমতি পাবেন।

আর লেখক মার্ক টোয়েন মৃত্যুর আগে লিখে গেছিলেন  তাঁর মৃত্যুর একশো বছরের আগে যেন  তাঁর ডায়েরি প্রকাশ করা না হয়। তাঁর ইচ্ছামতো মার্ক টোয়েনের লিখিত ডায়েরিটি ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়। ওয়ার্ডস ডরোথির লেখা ডায়েরি জগদ্বিখ্যাত হয়েছিল। ডায়েরি নিয়ে এমন অসংখ্য কাহিনি ছড়িয়ে আছে লিখিত ডায়েরির ইতিহাসে।

লাতিন শব্দ ডায়ারিয়াম থেকে ডায়েরি শব্দটির জন্ম। ডায়েরি অধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। প্রথম ব্যক্তিগত ডায়েরি প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। জন এভলিন নামক ইংলন্ডের এক ব্যক্তির আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ডায়েরি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সে সময়ের লেখকরাও তাঁদের লিখিত উপন্যাস ডায়েরির ফর্মাটে লিখতে শুরু করেন। ডায়েরিধর্মী প্রথম দিকে বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে স্যামুয়েল রিচার্ডসনের লেখা `পামেলা’ (১৭৪০) এবং এমিলি ব্র্যোন্টের ‘ঊথারিং হাইটস’ (১৮৪৭)। ক্রমশ সে সময়ের নারীদের মধ্যেও প্রভূত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ডায়েরি লেখার অভ্যেস।

প্রথম  ডায়েরি লেখা শুরু হয়েছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। `মাইসেলফ’ নামে এটি লিখেছিলেন রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস। গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল। তার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে এবং পূর্ব এশিয়াতেও ডায়েরি লেখার চল শুরু হয়েছিল। চিনে নবম শতাব্দীতে বিশিষ্ট পণ্ডিত লিও আও তাঁর ভ্রমণ কাহিনি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। একাদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার আহমেদ ইবনে বান্না উত্তর ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন এবং ডায়েরিতে তাঁর ভ্রমণ কাহিনি লিখে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম আধুনিক ডায়েরির মতো প্রতিটা তারিখ ধরে-ধরে নানা ঘটনা লিখে রাখতেন।

আর ডায়েরি শব্দের প্রথম প্রচলন হয় ১৬০৫ সালে। আবার কোনো-কোনো তথ্য বলছে প্রথম ডায়েরি পরিচিত হয়েছিল ১৫৮১ সালে। সর্বাধিক পরিচিত প্রাচীন ডায়ারি `ডায়ারিজ অব মেরের’ প্রাচীন মিশরীয় লগবুক। যার লেখক তুবা থেকে গিজায় চুনপাথর পরিবহণের বর্ণনা দিয়েছিলেন।

আর যাঁর কথা না বললে ডায়েরির কথা শুরুই হয় না তিনি সপ্তদশ শতকের সামুয়েল পাপিস। যিনি আজও সুপরিচিত তাঁর ঐতিহাসিক ডায়েরির জন্য।  তিনি লন্ডনের ‘গ্রেট ফায়ার,’ `গ্রেট প্লেগ’ সহ অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর  ডায়েরিতে। যা আজও অমূল্য তথ্য হিসাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর লিখিত ডায়েরিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮২৫ সালে। কেমব্রিজের ম্যাগডালন কলেজে আজও সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর লেখা ডায়েরিগুলি। তিনিই প্রথম ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখেন। পাপিসের সমসাময়িক জন এলভিনও সমধর্মী একটি উল্লেখযোগ্য ডায়েরি লিখেছিলেন।

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, মারি কুরী থেকে টমাস এডিশন, জনাথন সুইফটি কে না ডায়েরি লিখেছেন। ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ-এর ১৯৭৭ থেকে ৮৪ পর্যন্ত লেখা ডায়েরিই সাহিত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল পাঁচ খণ্ডে। স্যর ওয়াল্টার স্কট, কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শিলার, গেটে লিখে গেছেন নানা বর্ণময় চরিত্রের ডায়েরি। যার পাতায়-পাতায় শোক সুখ যন্ত্রণা, ঘটনার কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়ে আলোড়ন তুলেছে ইতিহাসের পাতায়। বিদগ্ধ মানুষ চমকে উঠেছেন সে সব পড়ে।

বেলজিয়াম থেকে এসে বাংলা লিখে ফাদার দ্যতিয়েন বাংলাভাষায় লিখেছিলেন ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’ নামে এক অভিনব সাহিত্যের রচনা। যা পড়ে বাঙালি গবেষকরাও চমকে উঠেছিলেন। আর সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যেও রয়েছে ডায়েরির কাহিনি থেকে রহস্য উদ্ঘাটনের কথা। রুদ্রশেখরের ডায়েরির কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে।

ডায়েরির নানান প্রকারভেদ রয়েছে, ভ্রমণ ডায়েরি, প্রেমের ডায়েরি, রিফ্লেকটিভ ডায়েরি, গ্র্যাটিচুড ডায়েরি, রিলিজিয়াস ডায়েরি, এমনকি খাদ্য তালিকার বা প্রেগন্যান্সি ডায়েরিও হতে পারে। হতে পারে হিসাব নিকাশের ডায়েরির মতো রাজনৈতিক ডায়েরিও। পৃথিবীর অসংখ্য গুণী মানুষই ডায়েরি লিখে গেছেন।  এমন ভাবেই হয়তো ডায়েরির পাতায় করোনার আক্রমণ মৃত্যু, লকডাউন, এর ইতিহাস দৈনন্দিন মৃত্যুর হিসাব কেউ লিপিবদ্ধ করছেন।

এমন রোমাঞ্চ, ইতিহাসপ্রেম প্রণয় হিসাব নিকাশের ডায়েরি আর লেখা হবে কিনা কে জানে এখন সব প্রযুক্তিময় হয়ে গেছে। আধুনিক হয়ে গেছে। বদলে গেছে ডায়েরির জগতও। এখন ওয়েব যুগ। ব্লগের দুনিয়া, ওয়েব ডায়েরি, লাইভ জার্নাল। আর এই বিস্তীর্ণ ডায়ারির বিবর্তন নিয়েই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আলেকজান্দ্রা জনসন-এর লেখা একটি আস্ত বই, `এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ডায়েরিজ ফ্রম পাপিস টু ব্লগ’।

ভাস্কর ভট্টাচার্য

 

 

 

 

লাইভ টিভি দেখুনhttps://chetana.tv/

বাংলার প্রথম এডুকেশনাল চ্যানেল

 

 

Advertisement

Imprint
Responsible for the content:
jibikadishari.co.in
Privacy & Terms of Use:
jibikadishari.co.in
Mobile website via:
WordPress AMP Plugin
Last AMPHTML update:
22.04.2024 - 03:59:55
Privacy-Data & cookie usage: