মৎস্য ধরিব, খাইব সুখে। সুখে থাকবার জন্য নিজের পেশাগত উন্নতির আবশ্যকও রয়েছে। আর সেই উন্নতি নিয়ে আসা যেতে পারে মৎস্যর উপর নির্ভর করেও। মাছের উৎপাদন, বণ্টন, সংরক্ষণ সমস্ত কিছুর পিছনে এক বিশাল শিল্প এবং পেশাদারদের হাত রয়েছে। মাছ সংক্রান্ত পড়াশুনার উপর নির্ভর করে বহুমুখী পেশার জগতে প্রবেশ করা যেতে পারে মৎস্যবিজ্ঞানের ছোট-বড় নানা দিকে। ভারতের মতো নদীমাতৃক দেশে মাছ উৎপাদনের এক বিশাল বাজার রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিকভাবে এই বাজারে মন্দা আসার সম্ভাবনা তো দূরের কথা, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির হাত ধরে আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে ফিশ ইন্ডাস্ট্রি। এর সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে মৎস্যবিজ্ঞান শাখার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের।
মৎস্যবিজ্ঞান কী?
পুকুর-নদী-সমুদ্র থেকে খাবার থালা পর্যন্ত মাছ পৌঁছে দেওয়ার পেছনে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন, প্রজনন, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বাজারে পৌঁছে দেওয়া। এসব বিষয়ের উপর পড়াশুনার নানা দিক রয়েছে ফিশারিজ সায়েন্সে। বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনা করার পর সরাসরি ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ম্যানেজমেন্ট-এর মতো বিষয়ের দিকে ঝোঁক না থাকলে পেশাগতভাবে উন্নতি সাধনের জন্য মৎস্যবিজ্ঞান অন্যতম বিষয় হতে পারে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে। ভারতের খাদ্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মাছ। ফলে, ফিশারিজ সায়েন্স-এর মতো বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করার পর নিয়োগ, গবেষণা তথা কর্মক্ষেত্রে উন্নতির পথ প্রশস্ত।
যোগ্যতা কেমন লাগে?
বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলে মৎস্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির সঙ্গে বায়োলজি থাকলে ভালো হয়। এছাড়াও মাধ্যমিক স্তরে অতিরিক্ত বিষয় হিসাবে পিসিকালচার বা মাছচাষ বিষয় থাকলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। বাঙালিদের সহজাতভাবেই মাছের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। তবে ফিশারিজ নিয়ে পড়াশুনা করতে গেলে স্বভাবতই মাছ সম্পর্কযুক্ত সমস্ত ব্যাপারে বাড়তি আগ্রহ থাকা দরকার। এছাড়া পরবর্তীকালে পেশার জগতে সুবিধার জন্য কথাবার্তায় দক্ষতা, দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিকূলতার মধ্যে মাঠেঘাটে কাজ করার অভ্যাস থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ইকোলজি, নিউট্রিশন এই সমস্ত বিষয়গুলি সম্বন্ধেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
কী কোর্স রয়েছে?
উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর মৎস্যবিজ্ঞান নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি বিএফএসসি করা যেতে পারে। বিএফএসসি পাশের পর এমএফএসসি করতে পারবেন। মৎস্যবিজ্ঞান পড়ার পরবর্তীকালে ফিশারিজ নিয়ে গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত হওয়া যেতে পারে। সেন্ট্রাল ইনস্টটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশন-এ ভর্তি হওয়ার জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ-এর আয়োজিত অল ইন্ডিয়া লেভেল কমন এন্ট্রান্স টেস্ট দিতে হবে। ফিশারিজ সায়েন্সের ক্যাপচার, কালচার এবং হারভেস্ট টেকনোলজি নিয়ে সার্বিকভাবে কোর্স করানো হবে স্নাতক স্তরে। অ্যাকোয়াকালচার, মেরিকালচার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশারিজ, ফিশ প্রসেসিং, পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি, ফিশ নিউট্রিশন, প্যাথলজি, এনভায়রনমেন্ট, ইকোলজি এবং এক্সটেনশন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে হবে ফিশারিজ সায়েন্সের ছাত্র-ছাত্রীদের। মাছচাষ, ফিশারির নানা যন্ত্রপাতি মেরামতি, ফিশিং ভেসেল অর্থাৎ মাছধরা জাহাজ সংক্রান্ত নানা বিষয় ইত্যাদির সার্টিফিকেট-ডিপ্লোমা কোর্সও আছে।
কোথায় পড়া যায়?
এ রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে পড়ার জন্য ভর্তি হতে পারবেন। স্নাতক কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি এবং ইংরাজি মিলিয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে প্রয়োজন। সংরক্ষিত শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ নম্বরের ছাড় দেওয়া হয়। বিএফএসসি পাশ করলে এমএসএসসি পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। www.wbuafsce.org আরও বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবেন। সেন্ট্রাল ইনস্টটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশন-এ ভর্তি হওয়ার জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে। সে ব্যাপারে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনের নিমপীঠ ও নরেন্দ্রপুর কেন্দ্র এবং বিভিন্ন এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও ছোটখাটো প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও রয়েছে সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ব্যারাকপুর, কলকাতা-১২০ যোগাযোগ- 03325921190.
কাজের ধরন কেমন?
বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা করার পর মাছের উৎপাদন, প্রতিপালন, প্রজনন, সংরক্ষণ, বাজারজাত করা সমস্ত বিষয়ের কাজের যুক্ত থাকতে হবে। এই বিষয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাছের জন্ম, বংশবিস্তার, অভ্যাস, প্রজনন সমস্ত কিছু যুক্ত রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে মাছের ফার্ম, হাজব্যান্ড্রি, অ্যাকোয়াটিক অর্গানিজমের বিষয়গুলিও রয়েছে। অ্যাকোয়াকালচারিস্ট, ফার্ম ম্যানেজার ইত্যাদি নানা পদে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি, যোগান, আমদানি-রপ্তানি সমস্ত কিছুই বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে উন্নত করা হয়েছে, যেখানে ফিশারিজ স্টাডিজ নিয়ে প্রশিক্ষিত কর্মীদের ভমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কাজের ক্ষেত্রে মিসলেনিয়াস সার্ভিস/ সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট অফিসার, ফিশারিজ এক্সটেনশন অফিসার, ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট অফিসার এইরকম নানা পদে কাজ পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া মাস্টার ডিগ্রি করার পর শিক্ষকতার কাজও করা যেতে পারে।
পেশার চাহিদা কতটা?
ভারত মাছ রপ্তানির দিক থেকে পৃথিবীতে সপ্তম স্থানে রয়েছে। কয়েক কোটি মানুষ মৎস্যশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে মাছের ব্যবসা-বাণিজ্যে বহুল উন্নতি সাধন হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। প্রতিটি রাজ্যেই আলাদা করে ফিশারিজ দপ্তর রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন অফিসার র্যাঙ্কে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বা স্টাফ সিলেকশন কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয় বিএফএসসি, এমএফএসসি পাশ প্রার্থীদের। ফিশারিজ দপ্তরের বাইরেও ফিশারিজ সার্ভে অব ইন্ডিয়া, মেরিন প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিতে কাজের সুযোগ আছে। সরকারি জায়গার বাইরেও এগ্রিকালচার ফার্ম, হ্যাচারি, মেরিন প্রোডাক্টস ইত্যাদি ক্ষেত্রের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাতেও নিয়োগ হয়। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থাও প্রচুর বিনিয়োগ করছে এরকম লাভজনক শিল্পে, যা প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের চাহিদা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কৃষি ও মৎস্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে ও গবেষণা সংস্থায় শিক্ষকতা বা গবেষণার রাস্তাও খোলা রয়েছে।
একনজরে
১) ভারতের মতো নদীমাতৃক দেশে মাছ উৎপাদনের এক বিশাল বাজার রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিকভাবে এই বাজারে মন্দা আসার সম্ভাবনা তো দূরের কথা, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির হাত ধরে আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে ফিশ ইন্ডাস্ট্রি। এর সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে ফিশারি সায়েন্স বিষয়ের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের।
২) বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলে মৎস্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির সঙ্গে বায়োলজি থাকলে ভালো হয়।
৩) সেন্ট্রাল ইনস্টটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশন-এ ভর্তি হওয়ার জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ-এর আয়োজিত অল ইন্ডিয়া লেভেল কমন এন্ট্রান্স টেস্ট দিতে হবে।
৪) বিভিন্ন ধরনের মাছের জন্ম, বংশবিস্তার, অভ্যাস, প্রজনন সমস্ত কিছু যুক্ত রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে মাছের ফার্ম, হাজব্যান্ড্রি, অ্যাকোয়াটিক অর্গানিজমের বিষয়গুলিও রয়েছে।
৫) ফিশারিজ দপ্তরের বাইরেও ফিশারিজ সার্ভে অব ইন্ডিয়া, মেরিন প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিতে কাজের সুযোগ আছে। সরকারি জায়গার বাইরেও এগ্রিকালচার ফার্ম, হ্যাচারিমেরিন প্রোডাক্টস কোম্পানি বিভিন্ন প্রাইভেট জায়গাতেও কর্ম খুঁজে নেওয়া যায়।