ভারতীয় সময় রাত আড়াইটা। ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায় জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরিতে ভেসে উঠল স্বাতী মোহনের গলা। গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করলেন “তিনি” সুস্থ অবস্থায় সসম্মানে মাটিতে পা রেখেছেন। “তিনি” বলতে পার্সিভিয়ারেন্স, মঙ্গলের মাটিতে পা রাখলেন গতকাল রাত্রে। ফের একবার রেকর্ড গড়ল নাসা। সর্বাধুনিক ল্যান্ডার রোভার পার্সিভিয়ারেন্স আগামী কয়েক বছর ধরে কাজ চালাবে মঙ্গলের মাটিতে। করবে প্রাণের সন্ধান। আগামী কয়েক বছর, মঙ্গলের মাটি, জীবাশ্ম সমস্ত কিছু সংগ্রহ করে বাড়ি (পড়ুন পৃথিবী) ফিরে আসবে ২০৩০ নাগাদ।
মিশন মঙ্গল এর আগে অনেকবার দেখেছে পৃথিবী, তবে সভ্যতার ইতিহাসে এবারের মিশনের বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, ল্যান্ডার-রোভার হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করে যাবে পার্সিভিয়ারেন্স। তার থেকেও বড় বিষয় হল, এই প্রথম কোনো ল্যান্ডার-রোভারের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে একটি হেলিকপ্টার যার নাম “ইনজেনুইটি”। ল্যান্ডার থেকে ইনজেনুইটি ওড়ানো হবে মঙ্গলের আকাশে। মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে যা একটি মাইলফলক।
এই পুরো কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতীয় হিসাবে গর্বের জায়গা নেহাত কম নয়। “পার্সিভিয়ারেন্স”-এর গাইডেন্স, ন্যাভিগেশন এবং কন্ট্রোলস অপারেশনের প্রধান স্বাতী মোহন আমাদের দেশের বংশোদ্ভূত। তাছাড়াও, “ইনজেনুইটি” হেলিকপ্টারটির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাঙ্গালুরুর বাসিন্দা জে বব বলরাম। এখানেই শেষ নয়, রয়েছেন একজন বাঙালীও। আমাদের বর্ধমানের সৌম্য দত্ত। মনে আছে, ২০১২ সালে “কিউরিওসিটি”কে নামানো হয়েছিল একটি বিশালাকার প্যারাসুটের সাহায্যে। তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি বড় ও প্রযুক্তি সম্পন্ন প্যারাসুট পার্সিভিয়ারেন্সকে মঙ্গলের মাটিতে নামিয়েছে। কারণ পার্সিভিয়ারেন্স-এর কোনো অরবিটার ছিল না মঙ্গলের কক্ষপথে ঘুরে নামার জন্য। মঙ্গলে নামার সময় পার্সিভিয়ারেন্স-এর গতিবেগ ছিল শব্দের থেকে ১.৭৫ গুণ বেশি। যার জন্য প্রায় সাড়ে ২১ মিটার ব্যাসের প্যারাসুট দিতে হয়েছে পার্সিভিয়ারেন্সকে। প্যারাসুট খুলতে সময় নিয়েছে ২ সেকেন্ডের কম। গতিবেগ আস্তে-আস্তে কমিয়ে এনে সদর্পে লাল গ্রহে পা রেখেছে পার্সিভিয়ারেন্স।
মঙ্গলে পা রাখার বেনজির ইতিহাস:
১) ১৯৬৫ সালে ১৫ জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নাসা সফল “মেরিনার ৪” ফ্লাইব পাঠায় মঙ্গলে। এরপরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও নাসা একাধিক ফ্লাইব প্রজেক্ট করে মঙ্গলের উদ্দেশে
২) ১৯৭১ সালে ২ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো “মার্স ৩” প্রথম সফল ল্যান্ডার। মার্স-৩-এর সঙ্গে একটি রোভার পাঠানো হলেও অরবিটারের সঙ্গে সেটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তার কাজ অসফল থেকে যায়।
৩) ১৯৭৫ সালে নাসা মঙ্গলে ল্যান্ডার পাঠায় ভাইকিং ১ পি ভাইকিং ২। এর পরেও “পাথ ফাইন্ডার (ল্যান্ডার)”, “অপরচুনিটি” (ল্যান্ডার-রোভার), “ফিনিক্স” (ল্যান্ডার) সহ আরও ডজন খানেক ল্যান্ডার রোভার পাঠিয়েছে মঙ্গলে।
৪) নাসার পাঠানো ল্যান্ডার রোভারের মধ্যে অন্যতম “কিউরিওসিটি”, পাঠানো হয় ২০১১সালে। কিউরিওসিটি মঙ্গলে পদার্পণ করে ৬ আগস্ট, ২০১২-তে।
৫) ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও চিন অরবিটার ও ল্যান্ডার পাঠিয়েছে মঙ্গলে।
মঙ্গল অভিযানে ভারতের ভূমিকা :
ভারতের প্রথম আন্তঃগ্রহ মিশন শুরু হয় ২০১৩ সালে নভেম্বর মাসে। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন শুরু করে মার্স অরবিটার মিশন (মঙ্গলযান)।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পর ইসরো দ্বিতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা যারা প্রথম বারেই অরবিটার মিশনে সাফল্য পেয়েছে।
মঙ্গলযান ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করতে সফল হয়। অন্ধ্রপ্রদেশের “সতীশ ধাওয়ান স্পেস রিসার্চ সেন্টার” থেকে উৎক্ষেপণ হয়েছিল মঙ্গলযানকে।
২০২৫ সাল নাগাদ “মঙ্গলযান ২” লঞ্চ করার কথা রয়েছে ইসরো’র। অরবিটার মিশনের সঙ্গেও যাতে ল্যান্ডার-রোভার মিশন সংযুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা করছে ইসরো।
মঙ্গল সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য –
- রোমান যুদ্ধের দেবতার নাম অনুসারে এই গ্রহের নাম হয়েছে মার্স। মূলত মঙ্গলের পৃষ্ঠের ওপর আয়রন অক্সাইডের মাত্রা অত্যাধিক থাকায় গ্রহ জুড়ে লালাভ আবরণ।
- মঙ্গল সৌরমণ্ডলের দ্বিতীয় ছোট গ্রহ, আয়তনে পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের গোলার্ধ ৬,৭৯১ কিমি।
- সূর্য থেকে মঙ্গলের দূরত্ব ২২৭.৯ মিলিয়ন কিমি। স্বাভাবিকভাবেই মঙ্গলের উষ্ণতা খুব কম। সর্বোচ্চ ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মেরুতে উষ্ণতা কমে হতে পারে – ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
- মঙ্গলকে সর্বোচ্চ পর্বতের গ্রহ বলা যেতে পারে। অলিম্পাস মন্স নামের একটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে মঙ্গলে যা এভারেস্টের তিনগুন।
- মঙ্গলের দুটি উপগ্রহ রয়েছে “ফোবোস” এবং “ডেইমস”। পৃথিবীর থেকে মঙ্গলের দৈনিক গতির সময় ৩৭ মিনিট বেশি। মঙ্গল সূর্যকে পরিক্রমণ করতে সময় নেয় ৬৮৭ দিন।
Mars, Mars Mission, Sangbad Dishari