মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান: একনজরে বিশ্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভ্যুত্থানের ইতিহাস  

1111
0
Mayanmar, Aung San Su Kyi

ক্ষমতাচ্যুত হলেন মায়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর নোবেলজয়ী আন সান সু কি (Aung San Suu Kyi)। এই coup d’état-র মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা আবার নিজেদের হাতে নিল মায়ানমারের সেনাবাহিনী।

২০২০ সালের নির্বাচনে আন সান সুকি দ্বিতীয়বারের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর নির্বাচনী জালিয়াতি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল সেনাপ্রধানের। যদিও মায়ানমারের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করে। ২ নভেম্বর সেনা প্রধান মিং অং হাইং-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। আটক হন আন  সান সু কি সহ ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’র একাধিক নেতা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিন্দা প্রকাশ করেছে আমেরিকার জো  বাইডেন প্রশাসন, ব্রিটেন‌ও। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত সরকারও।

১৯৬২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মায়ানমারে মিলিটারি প্রশাসন চলত। ২০১৫ সালে আন সান সু কির নেতৃত্বে এনএলডি পার্টি নির্বাচনে জয়ী হয়। ১৯৯১ সালে গৃহবন্দি থাকাকালীন সমাজকর্মী সুকি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। বছরের শুরুতেই মায়ানমারের এহেন সেনা অভ্যুত্থান বা কু দে’তা অবশ্যই আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।

কু দে’তা (Coup d’état) কী?  

কু দে’তা শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে। কু অব দ্য স্টেট। একটি রাষ্ট্রশক্তির ওপর আঘাত এনে ক্ষমতার অবরোধ বা দখল ঘটানো সেনা অভ্যুত্থান বা কোনো বিরোধী সশস্ত্র শক্তির উত্থানের মাধ্যমে। ১৮০২ সালে ৭ জানুয়ারি, লন্ডনের “Morining Chronicle”-এ এধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয় ফ্রান্সের রাষ্ট্রশক্তির অবসান ঘটনার পরিপ্রেক্ষতে। ১৯৫০ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪৫৭টি সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনার কথা জানা যায়।

পৃথিবীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থানের নজির: 

  • ‘কু দে’তা’র সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হল নেপোলিয়নের ফ্রান্সের ক্ষমতা দখলের ঘটনা। মিশর অভিযানে ব্যর্থতার পর নেপোলিয়ন ১৭৯৯ সালে প্যারিসে ফিরে আসেন। ওই বছর ৯ নভেম্বর, নেপোলিয়ন ফরাসি কাউন্সিলের ২ জন ডিরেক্টরের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে রজার ডিউকসের কাউন্সিলের ক্ষমতার অবসান ঘটান, ফরাসি সংবিধান “Constitution of the Year  VIII” তৈরি হয়, ফ্রান্সের প্রথম কনসাল হিসাবে নেপোলিয়ান দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
  • এরপরেই যে ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন তা হলে জার্মানির বিয়ার হল পুৎশ (Putsch), যদিও এটি একটি ব্যর্থ কু দে’তা। হিটলারের নেতৃত্বে ১৯২৩ সালে ৮-৯ নভেম্বর হাজার দুয়েক নাৎসি বাহিনী মিউনিখ শহরের কেন্দ্রস্থলে মার্চ করে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৬ জন নাৎসি সদস্য নিহত হন. এই সংঘর্ষে হিটলার নিজে আহত হয়ে পালিয়ে যান। ঘটনার দুদিন পর হিটলারকে গ্রেফতার করাও হয়। বলা যেতে পারে এই ঘটনার পরেই জার্মানিতে হিটলারের খ্যাতির শুরু হয়।
  • পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনা বা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের ঘটনা কিউবা রেভোলিউশন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কসবাদী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাতে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ২৬ জুলাই তিনি ১৬০ জন বিদ্রোহীকে মনকাডো ও ব্যায়াম সেনাছাউনি আক্রমণের জন্য পাঠান। এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন বিখ্যাত আর্নেস্তো চে গোয়েভারা। ১৯৫৯ সালে ১ জুলাই অবশেষে কিউবার বিপ্লবের ফলে জেনারেল ফুলজেন্স বাতিস্তার শাসনের অবসান ঘটায়।
  • সম্প্রতি ২০২১ সালে মালিতে ধ্বংসাত্মক সেনা অভ্যুথান ঘটে। মালির প্রেসিডেন্ট আমাদো তোমানি ত্যুরোর বিপক্ষে মালি সেনার একাংশের বিদ্রোহ তৈরি হয়। সেনারা রাজধানী বার্নাকো অভিযান চালায়। প্রায় ১৫ হাজার সেনামৃত্যু ও লক্ষেরও বেশি মানুষের ঘরছাড়া হওয়ার ঘটনা ঘটে।
  • সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা আধিক্য দেখা যায় পাকিস্তানে। স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানে ছয়বার সেনা অভ্যুথানের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান সেনা প্রধান হিসাবে পারভেজ মুশারফ এমারজেন্সি ঘোষণা করে দেশের ক্ষমতা করায়ত্ত করেন।
  • সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতা দখলের উদাহরণ রয়েছে আরব প্রদেশের লিবিয়াতেও। ষাটের দশকের পর থেকে লিবিয়াতে রাজা ইদ্রিসের প্রভাব কমতে থাকে, দীর্ঘদিনের চাপা উত্তেজনার পর ১৯৬৯ সালে মুয়াম্মার গদ্দাফির নেতৃত্বে তৈরি হয় সেনা অভ্যুথান। সেই সময় ইদ্রিস তুরস্ক ও গ্রিসে ভ্রমণে বের হন, সেই অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গদ্দাফির নেতৃত্বে সেনাবাহিনী শুরু করে “অপারেশন জেরুজালেম”।  ১ সেপ্টেম্বর তারা সমস্ত  এয়ারপোর্ট, রেডিও স্টেশন, সরকারি দপ্তর দখলে নেয়।  রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গদ্দাফি “লিবিয়ান আরব রিপাবলিক” তৈরি করেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত গদ্দাফি লিবিয়াতে ক্ষমতাধীন ছিলেন।

 

Mayanmar, Aung San Su Kyi