তুলসী গৌড়া
প্রায় সত্তর বছর বয়সে যখন কম্পিত হাতে ভারতের সর্বোচ্চ পদ্মশ্রী সম্মান নিচ্ছেন তখন তুলসী গৌড়ার চোখেমুখে এক পরম তৃপ্তি। এই পুরস্কার পাবার পেছনে এক বিশাল অতীত রয়েছে। ফেলে আসা সেই দীর্ঘ জীবনের ৬ দশক তাঁর কেটে গেছে বন সংররক্ষণ, পরিবেশ চর্চা ও উন্নতমানের বীজ সংরক্ষণ ও রোপণের কাজে। দীর্ঘ ৬ দশক নিজের হাতেই রোপণ করেছেন ৩০ হাজারেরও বেশি চারা।
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তুলসী গৌড়া সত্তর বছর বয়সে তাঁর দীর্ঘ জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন ভারতের পদ্মশ্রী সম্মান। কর্নাটকের হালাক্কি উপজাতি সম্প্রদায়ের তুলসী গৌড়াকে বলা হয় `এনসাইক্লোপেডিয়া অব ফরেস্ট।’ তুলসীর জন্ম ১৯৪৪ সালে। কর্নাটকের হোন্নালি নামক গ্রামে। মাত্র দু বছর বয়সে ববাকে হারিয়েছিলেন তুলসী। যে বয়সে স্কুলের নার্সারিতে যাবার কথা সেই বয়সেই মায়ের হাত ধরে তুলসীর পরিবেশ নার্সারির হাতেখড়ি। তারপর আর থেমে থাকেননি।
হারেকালা হাজাব্বা
কারও কারও কাছে তিনি ‘অক্ষরা সান্তা’ (অক্ষর-সন্ত) নামে পরিচিত। যেন রূপকথা। তখন তার বয়স খুবই অল্প। নিরক্ষর হরেকালা হাজাব্বা খালি পায়ে কমলালেবু বিক্রি করছেন। এক বিদেশি এসে ইংরেজিতে কমলালেবুর দাম জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু হাজাব্বার ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয়। সেদিনের সেই ঘটনায় মনের মধ্যে তৈরি হয় জেদ। ঠিক করলেন তাঁর গ্রামের পড়াশোনার সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার জন্য চেষ্টা করবেন।
খুব সামান্য আর্থিক সচ্ছল একটি পরিবারে জন্ম নেওয়া হাজাব্বা অর্থ উপার্জন এবং পারিবারিক খরচে অবদান রাখার জন্য অল্প বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন। তিনি যে অঞ্চল থেকে এসেছেন সেখানে একটি স্কুল চালু করার জন্য কমলা বিক্রি করে তার সঞ্চয়ের কিছু অংশ রেখেছিলেন। তিনি একটি ছোট স্কুল চালু করতে সক্ষম হন। আজ, স্কুলটি, যেটি সরকারি সহায়তা এবং ব্যক্তিগত ব্যক্তিদের অনুদানে বেড়ে উঠেছে তা হাজাব্বা স্কুল নামে পরিচিত। মাত্র কয়েকজন ছাত্র নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ই আজ ১.৫ একরের ওপর মাঙ্গালুরু শহরের কাছে নিউপাদাপু গ্রামে গড়ে উঠেছে স্কুল। দিনে দিনে সেই স্কুল ক্রমশই কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর হাজাব্বার স্বপ্নও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। স্কুল থেকে তিনি এখন একটি মহাবিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার জন্য হাজাব্বার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাল ভারত সরকার ২০২০ সালের পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করে। ম্যাঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটিতে বি.কম স্নাতক স্তরে পড়ানো হয় তাঁর জীবন অবদানের কথা। ৬৮ বছরের এই মানুষটিকে নিয়ে সমাজকর্মী এবং লেখক ইসমত পাজির লিখে ফেলেছেন `লাইফ স্টোরি অব হারেকালা হাজাব্বা’ নামে গোটা একটি বই। বিভিন্ন সংবাদপত্র তাঁর কথা লিখেছে।
রাহিবাই
রাহিবাই সোমা পোপেরে শুধু নিজের জন্য বঁচেন না, মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হাইব্রিড বিদেশি বীজের রমরমা থেকে দেশীয় বীজকে রক্ষা করতে এবং তার গুণাগুন তুলে ধরতে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেনে দেশীয় বীজে চাষ করলে শুধু ফসল ভালোই হয় না, স্বাস্থ্যের পক্ষেও অনেক উপকারী। জমির পক্ষে তো বটেই। মোদ্দা কথা বড় বীজ কোম্পানিগুলির হাইব্রিড বীজের কারণে যে দেশীয় বীজের বিলুপ্ত ঘটছে তারই বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মহারাষ্ট্রে আহমেদা নগরের এই নারী।
দেশীয় বীজ, কৃষি-জীববৈচিত্র এবং খাদ্য সম্পদ সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে চলেছেন মহারাষ্ট্র কৃষি সমাজে। যিনি ইতিমধ্যে পরিচিত হয়েছেন `বীজ মা’ নামে। একতা কাপুর, কঙ্গনা রানাউত, পিভি সিন্ধু সহ অন্যান্য লড়াকু নারীদের সঙ্গে স্কুলের গণ্ডি না ছোঁয়া রাহিবাই সোমা পোপারেও আজ একাসনে। ভারতের উচ্চ সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়ে দেখালেন নিজের প্রতি নিষ্ঠা ও লড়াই চালিয়ে গেলে সাফল্য একদিন আসবেই।
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
এই সব সম্মানের দলেই রয়েছে `সদাই ফকিরের পাঠশালা।’ বর্ধমানের আউসগ্রামের সুজিত চট্টোপাধ্যায় তাঁর সমস্ত সময় ও শিক্ষাকে বিতরণ করে চলেছেন এবং সমাজে বঞ্চিত শিশুদের জীবন গড়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন গ্রামের মাটিতে।
শিশুদের মনে শিক্ষার আলো ও বড় হবার স্বপ্ন এঁকে চলেছেন সুজিত চট্টোপাধ্যায়। তিনিও সমজে অসামান্য অবদানের জন্য এ বছর পেয়েছেন ভারত সরকারের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্ম সম্মান।