ওরা হারেনি

1025
0
Paralympics 2021
Courtesy: The Times of India

কারও শরীরের নিম্নাঙ্গ অসাড়, কারও একটা পা নেই, কারও পা আছে তো শরীর ভারসাম্যহীন। শিশু বয়সেই পোলিয়োর কারণে কারও শরীর আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়, কেউবা কোনো পথ দুর্ঘনায় একটা অঙ্গ হারিয়েছেন। কারও আবার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি। অঙ্গহীন তো কী হয়েছে, মনের জোর, অদম্য সাহসে ভর করেই ওরা জীবনে ঘুরে দাঁডিয়েছেন শুধু নয়, প্যারাঅলিম্পিকের মতো বিশ্বক্রীড়ায় অংশ নিয়ে সোনা ব্রোঞ্জ পদক জিতে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন সব বাধা ঠেলে কেমনভাবে তাদের জন্য আয়োজিত অলিম্পিকে পদক জেতা যায়। টেলিভিশনসহ সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় তাঁরা ফুটে উঠেছেন সাফল্যের উজ্জ্বল হাসিতে। দেশের প্রধানমন্ত্রী সহ গোটা দেশের মানুষ স্যালুট জানিয়েছে এই সব প্রতিবন্ধী প্রতিযোগীদের।শারীরিক ভাবে অক্ষম বা প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদগণ নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।তৈরি করেন না-হারার কাহিনি।

দিব্যাঙ্গ হয়েও প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়েও ওঁরা বিশ্বজয়ের পদক জয়ী হয়ে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন তাঁরাও পারেন। অন্যান্য স্বাভাবিক খেলাধুলোর আলোর থেকে অনেকটা দূরে থাকলেও নিঃসাডে তাঁরা সাধনা করে গেছেন। সেই সাধনারই ফল দেখা গেল টোকিয়োয় বিশ্ব প্যারাঅলিম্পিকের মতো প্রতিযোগিতায়।

বিশ্বের নানাপ্রান্তের প্রতিবন্ধী অ্যাথলিটদের নিয়েই প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিকের আসর বসে বিশ্বের নানান দেশের নানা প্রান্তে।এ বছর বসেছিল টোকিয়োয়। মোট প্রতিযোগীর সংখ্যা ছিল ১১,৬৫৬ জন। ৩৩৯টি ইভেন্ট, এবং ৩৩টি স্থানে এই প্রতিযোগিতার মহাযজ্ঞ চলল দশ দিন ধরে।

ভারতও অংশ নিয়েছিল। এবারের প্যারাঅলিম্পিকে ভারতের সাফল্য চোখে পড়ার মতো।এর আগে ভারত কোনো প্রতিযোগিতায় একসঙ্গে এতগুলো পদক আনতে পারেনি। বিশ্ব প্যারাঅলিম্পিকের ইতিহাসে ভারত প্রথম ২৫-এ শেষ করল। পদক তালিকায় ভারতের স্থান ২৪। মোট প্রাপ্ত পদকের সংখ্যা ১৯। তারমধ্যে ৫টি সোনা, ৮টি রুপো, ৬টি ব্রোঞ্জ। মোট ৫৪ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৯ জন সফল হয়েছেন। শুধুমাত্র ব্যাডমিন্টনেই ৪টি পদক এসেছে। ব্যাডমিন্টনে সোনা জিতলেন কৃষ্ণ নাগার। যাঁর সঠিক ভাবে শারীরিক বৃদ্ধি হয়নি।

এবারে এই প্যারা অলিম্পিকেই প্রথম ভারতীয় হিসাবে টেবল টেনিসে ফাইনালে উঠে রুপোর পদক পেয়েছেন ভাবিনা প্যাটেল। ২০১৬ সালে দীপা মালিকের পর টেবল টেনিসে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি। গুজরাটের মেয়ে ভাবিনা ছোটবেলায়ই পোলিয়োয় আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে গিয়েছিল। সেই মেয়েই আজ টেবল টেনিসে পদক জয়ে গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করল। শুধু ভাবিনা প্যাটেলই নয়, একে একে উঠে এসেছে নিশাদ কুমার (হাইজাম্পে রুপো), অবনী লেখারার মতো নারীর নামও। মাত্র ১৯ বছর বয়সি অবনী লেখারা এয়ার রাইফেল শুটিংয়ে রেকর্ড করেছেন। অন্যদিকে ডিসকাস থ্রো তে যোগেশ কাঠুনিয়া, জ্যাভলিনে সুমিত অ্যান্টিল, ছাড়াও হরিয়ানার মনীশ নরওয়াল ৫০ মিটার এয়ার পিস্তলে সোনা জিতেছেন। উল্লেখ্য, ডান হাতে ত্রুটি নিয়েই জন্মেছিলেন মণীশ। ২০১৬ সালে শুটিং শুরু করেন হরিয়ানার হয়ে। শুটিং বিশ্বকাপে সোনা জিতেছিলেন বিশ্ব রেকর্ড গডে। এবার প্যারাঅলিম্পিকেও সোনা পেলেন।

এই প্যারাঅলিম্পিকেই ব্যাডমিন্টনে এসেছে ৪টি পদক।ওড়িশার লড়াকু খেলোয়াড প্রমোদ ভগতের পাশাপাশি আছে এক বাঙালির নামও। মনোজ সরকার প্রথম বাঙালি হিসেবে এ বার প্যারাঅলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদক পেলেন। পিতা-মাতা হারানো উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরের প্যারা-ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় মনোজ সরকারের চিকিতসার ভুলে শরীরের নীচের অংশ অসাড় হয়ে যায় ছোটবেলায়। ২০১৫ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ব্রোজও পেয়েছিলেন। অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত মনোজের এই পদক বাঙালির গর্ব। অন্যদিকে শুটিঙে ব্রোঞ্জ পেয়েছেন সিংরাজ আধানা। পোলিয়োয় তাঁর শরীরের নীচের অংশ আজও অসাড়। ২০১৮ সালে ফ্রান্সে শুটিং বিশ্বকাপে সোনা ও রুপো জিতেছিলেন হরিয়ানার এই শুটার। নজর কেডেছেন বুদ্ধনগর জেলার সুহাস গৌতম। প্রতিবন্ধী হয়েও লকডাউনে প্রভূত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও চালিয়ে গেছেন কঠোর অনুশীলন। সেই অনুশীলনের জোরেই মানসিক দৃঢ়তায় জিতে নিয়েছেন পদক।

 

শুরুর কথা

প্যারা অলিম্পিকের শুরু এক নিউরো-সার্জেনের হাত ধরে। সেটা ১৯৪৮ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনের মেরুদণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিকরা দীর্ঘদিন হাসপাতলে চিকিতসাধীন। পঙ্গু আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিকদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে জার্মান নিউরোলজিস্ট স্যর লুডভিগ গুটম্যান স্থির করলেন সকল সৈনিকদের নিয়ে হুইল চেয়ারে বসেই এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করবেন। সেইমতোই ২৩টি দেশের ৪০০ জন প্রতিযোগী ক্রীড়াবিদকে নিয়ে শুরু হল বিশ্ব প্যারাঅলিম্পিক প্রতিযোগিতা। উল্লেখ্য, সে বছর হুইল চেয়ারে বসেই মার্গারেট মাউগান তিরন্দাজিতে প্রথম পদক পাওয়া মহিলার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

Paralympics
Courtesy: The Bridge

১৯৪৮ সাল স্টোক ম্যানেল ভিলেতে শুরু হলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে প্যারালিম্পিক গেমস ১৯৬০ সালে ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে শুধুমাত্র হুইলচেয়ারে বসেই প্রতিবন্ধী প্রতিযোগীরাই অংশগ্রহণ করত। তারপর থেকে চার বছর অন্তর টোকিও, জাপান, তেল আবিব, টরেন্টো,অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চিন, গ্রিস, নেদারল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশে প্যারাঅলিম্পিক আয়োজিত হয়ে চলেছে। দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে খলার ইভেন্ট সংখ্যা। শেষ ২০১৬ সালে প্যারাঅলিম্পিক হয়েছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে। করোনার কারণে ২০২০র পরিবর্তে এ বছর আয়োজিত দেশ ছিল টোকিয়ো।

স্মরণীয়ণীয় সম্প্রতি একমাস আগে এই টোকিয়োতেই স্বাভাবিক অলিম্পিক্সেই নীরজ চোপড়ার সোনা সহ ভরত পেয়েছিল সাতটি পদক। প্যারালিম্পিক্সে এল ২৩ পদক।

 

বর্ণময় পদকজয়ীরা

প্যারাঅলিম্পিকে এই সব পদকের কাহিনিরই সবচেয়ে বর্ণময় দুই নারী হলেন ত্রিশ্চা জর্ন হাডসন (Trischa Zorn Hudson) ও ডেম ট্যামি গ্রে খম্পসন।১৯৬৪ সালে আমেরিকায় জন্মানো জন্মান্ধ প্যারালিম্পিক সাঁতারু ত্রিশ্চা হাডসন প্যারালিম্পিক্সে মোট ৫৫টি পদক জয় করে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। তারমধ্যে ৪১টি সোনা ৯টি রুপো ও ৫টি ব্রোঞ্জ। ১৯৮৮ সালে ১০টি ইভেন্টে ১০টি সোনা জিতেছিলেন। এবং গ্রেট ব্রিটেনের হুইলচেয়ার রেসার গ্রে থম্পসন ১১টি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা অ্যাথলিট যিনি ৪০০ মিটরের জন্য ১১টি স্বর্ণপদক পেয়েছেন।

সবিশেষ বলা যায়, নজরকাড়া নজিরবিহীন রেকর্ড করার পাশাপাশি দিন দিন প্যারাঅলিম্পিক্সের সাফল্যের কাহিনিই যেন বলছে সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে চলারই খেলা হচ্ছে প্যারাঅলিম্পিক।

 

ভাস্কর ভট্টাচার্য