World Mosquito Day : ক্ষুদ্র তবে তুচ্ছ নয় সুপ্রাচীন মশক

1948
0

পৃথিবীর জীবজগতের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগই কীট পতঙ্গের দখলে। এবং প্রতিনিয়ত মানুষের চলাফেরায় জীবনযাত্রায় এরা একটা বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। কেউ শত্রুর কেউ মিত্রর। শত্রুর দলে মশা। মশার জীবনবৃত্তান্ত সুপ্রাচীন। এই ছোট্ট প্রাণীটিকে নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। কেউ কেউ বলেন প্রকৃতিতে এর অবস্থান নাকি কোটি-কোটি বছর আগে থেকে। রহস্যময় পৃথিবীর এক রহস্যময় প্রাণী বা পতঙ্গই বলা যেতে পারে। আবার গ্রিক পুরাণ বলে মশা নাকি আগে ছিল দৈত্যকুলে। সেই রাক্ষসকে হত্যা করার পরই সে মশক রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। মশা নিয়ে সাহিত্য উপন্যাসে কম আলোচিত হয়নি। ঈশ্বর গুপ্তর “রেতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কলকেতায় আছি” বা অন্নদাশঙ্কর রায়ের “দেশান্তরী করলো আমায় কেশনগরের মশা” বা জীবনানন্দ দাশের চাবুকের মতো উক্তি “মশাদের সঙ্ঘারামে ব়েচে থেকে জীবনের স্বাদ ভালোবাসে” যারা তাদের প্রতি। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুন্দরবনের দৈত্যাকার মশা বা যারা মনুষ্যবসতিগুলোকে নিজ-নিজ এলাকার প্রজার মতো ভোগাধিকারে দেখে, সেই রসিকতাও ভোলার নয়।
এমন মনুষ্য হন্তারক প্রাণী পৃথিবীতে সম্ভবত দ্বিতীয় নেই। হেঁয়ালি-প্রবাদেও এই প্রাণিটির অজস্র বর্ণনা। যেমন ধাঁধা আছে, ‘এক বাহাদুর গান করে, বসে বসে তির মারে’ বলো তো কে? এক কথায় উত্তর: মশা। তেমন‌ই প্রবাদে আছে ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা কয় কত জল।’ অথবা মশা মেরে হাত কালো করা। তবে ব্যঙ্গের সেই প্রবাদটিই বোধহয় সব থেকে বেশি আমাদের জীবনে প্রত্যাঘাত করেছে, সেটি হল ‘মশা মারতে কামান দাগা’। এই প্রবাদটি যে কত সত্য তা সারা বিশ্ব এখন হাড়ে-হাড়ে টের পায়। পৌরসভার “মশা মারার কামান” এখন পরিচিত দৃশ্য।
বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মশকবাহিনী বিষাক্ত হুল বা কানের কাছে আতঙ্কের গুঞ্জন নিয়ে হাজির নয়। রাশিয়া, আমেরিকা, জাপান, চিন, দক্ষিণ আফ্রিকা এশিয়ার সব অঞ্চলেই এর উপদ্রব। সে তার ৬টি  ধারালো ছুঁচের মতো সরু শূঁড় নিয়ে শোষণ-নিধন চালিয়ে আসছে। জাপানে প্রতিবছর মশার কামড়ে মারা যায় ৪,২০,০০০ মানুষ। অন্য কোনো-কোনো দেশের হিসাব আরও ভয়াবহ।
আর সেই নিধনকারীরা কিন্তু কোনো পুরুষ মশা নয়, স্ত্রী মশা। স্ত্রী মশার কামড়েই ম্যালেরিয়া হয়। ও পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নাকি তাদের বেশি প্রিয়। কথায় বলে যত রক্ত তত মশা। আর মশা মানেই ম্যালেরিয়া ডেঙ্গুর আতঙ্ক। সারা বিশ্বজুড়ে এই আতঙ্ক। তবে একদিকে যেমন আতঙ্ক অন্যদিকে তেমন মর্মান্তিক খবরটাও মনকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে। বেচারি পুরুষ মশাদের জন্য। নারী মশাদের কামড়েই ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু জাতীয় অসুখ হয়, অথচ নারী মশাদের কারণে বেমক্কা অসহায়ভাবে নির্বিচারে প্রাণ দিতে হয় পুরুষ মশাদের। ওষুধ দিয়ে নির্বাচারে মশা মারার সময় তো আর বিচার করা হয় না কে পুরুষ মশা আর কে মেয়ে মশা। অন্যদিকে মশা নিধনে অজান্তে আমরা নারী হত্যার মতো একটা অপরাধও করে চলেছি। একটু ভালো করে বললে বোঝায় মাতৃহত্যা। জননী মশা রক্ত খেয়ে তার ডিম ফোটানোর কাজে লাগায়। সেই হত্যা একদিক থেকে বিষাদঘন এক ব্যাপার। অন্যদিকে আমরা যেন ভুলে না যাই ইতিহাসের সেই কাহিনি। এই মশাই ভারতবর্ষের মান বাঁচিয়ে ছিল বীর আলেকজান্ডারের গায়ে হুল ফুটিয়ে। তিনি যখন ভারতীয় রাজাদর একের পর এক পরাজিত করে চলেছেন, তখন ভারতীয় এক মশার কামড়েই ব্যবিলনে আলেকজান্ডার প্রাণ হারিয়েছিলন। আর মশাকে ঘিরে অর্থনীতি? আন্তর্জাতিক বাজারে কত মশা নিধনের ওষুধ এখন লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা করে চলেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ করে উপার্জন করে চলেছেন ভাবলে বিস্ময় জাগে।
প্রায় তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে পৃথিবীতে। প্রতি বছর দশ লক্ষ এবং প্রতি দশকে প্রায় ৬ কোটি মানুষ শুধুমাত্র মশার কামড়েই মারা যায়। পৃথিবীতে সব মিলিত  যুদ্ধের থেকেও মশার কাড়ে প্রাণহানির সংখ্যা অধিক। এই পরিসংখ্যানের তারতম্য অবশ্য আছেই। এক কথায়, মশার কামড়ে লক্ষ কোটি মানুষ বছর-বছর প্রাণ হারায় সারা বিশ্বে। আফ্রিকায় এক সময় প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একজন করে প্রাণ হারাত। আরও বলার, এই ছোট প্রাণীটি প্রতি মিনিটে ৫০০ বার ডানা ঝাপটায়, এক সঙ্গে ৩০০টি ডিম পাড়ে, ৪০ ফুটের ওপরে উঠতে পারে না। ৩০ দিন বেঁচে থাকে। এমন অসংখ্য তথ্য রয়েছে শুধু নয়, একে নিয়ে গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়।
বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালে নিরলস গবেষণায় প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন ম্যালেরিয়ার একমাত্র কারণ মহিলা মশা। তিনি মশা নিয়ে গবেষণায় দেশে-বিদেশে যেমন ঘুরে বেরিয়েছিলেন তেমন‌ই কলকাতায় বসেই তাঁর যুগান্তকারী গবেষণার প্রমাণ রেখেছিলেন। ভারতের কুমায়ুনে রোনাল্ড রসের জন্ম।১৮৫৭ সালে। বাবা ছিলেন সামরিক বাহিনীর চিকিৎসক। ভারতের মাটিতে বসেই রোনাল্ড রস তাঁর গবেষণা চালান এবং ম্যালেরিয়ার কারণ খুঁজে পান। এজন্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তিনি শুধু ম্যালেরিয়ার কারণ নয়, রোগ দমন করার উপায় সম্বন্ধেও যুগান্তকারী বই লিখেছিলেন। বইটির নাম, ‘দ্য প্রিভেনশন অব ম্যালেরিয়া’।
১৮৯৭ সালে সেই আবিষ্কারের কারণেই লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন প্রতি বছর ২০ অগস্ট দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড মসকুইটো ডে’ পালন করে আসছে। সারা বিশ্বেই এই দিনটি নানা আয়োজনে মশা নিধনের বার্তা ও নানা ভাবে সজাগ বার্তা দিতে পালিত হয়। প্রতি বছর বিভিন্ন রকম পোস্টারও তৈরি হয়। থাকে নানান ভাবনাও। আমেরিকায় গড়ে উঠেছে আমেরিকান মসকুইটো কন্ট্রোল অ্যাসোশিয়েসন।
মশা তার চরিত্র বদলেছে সঙ্গে বদলেছে রোগের নামেরও। যেমন মশার কামড় থেকেই ম্যালেরিয়া ছাড়াও ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জাইকা প্রভৃতি রোগ ছড়িয়ে থাকে। মশা শুধু মানুষকেই নয় গরু-মোষ সহ অন্যান্য প্রাণীর রক্ত খেয়েও বেঁচে থাকে। নানা দেশে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে এই প্রাণীটির হাত থেকে বাঁচা এবং মৃত্যুহার কমানোর সচেতনতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও নির্মূল করা আজও যায়নি। উপরোক্ত তথ্য তার প্রমাণ। এখনও দিনে মাছি, রাতে মশা নিয়েই ঘর করে বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষ।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই মশার কামড়েই মারা গেছিলেন।
মশাকে যদি পতঙ্গের দলভুক্ত করা যায়, তাহলে, মাইকেলের সেই লাইন আজও স্মরণীয়, ‘জ্বলন্ত পাবক শিখা’ বা ‘পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়’। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ কারও হাতেই ছাড় পায়নি এই নিদ্রাহরণকারী, প্রাণঘাতী পতঙ্গটি।
ভাস্কর ভট্টাচার্য
Mosquito, General Knowledge