Site icon জীবিকা দিশারী

আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস


`অনুবাদ ছাড়া আমি আমার নিজের দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকব।নিজের ভাষার বাইরে বাইরের দুনিয়া আমার কাছে অনেকটাই অন্ধকার। তাই অনুবাদক আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। তিনি আমাকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।’ এমন কথা বলেছিলেন ইতালীয় লেখক ইতালো ক্যালভিনো। তাঁর সময়ের লেখকের সর্বাধিক রচনা অনূদিত হয়েছিল বিভিন্ন ভাষায়। তাঁর রচিত `আওয়ার অ্যানসেস্টরস ট্রিলজি’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এক সময়। এই লেখকেরই `ইনভিজিবিল সিটিস(১৯৭২)`ইফ অন উইন্টারস নাইট এ ট্রাভেলার’ (১৯৭৯) সব জনপ্রিয় বই অনুবাদ হয়ে বিভিন্ন ভাষার পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে।

এই ইতালিতেই ৪২০ বিসিতে জন্মেছিলেন এক ধর্মযাজক, লেখক-অনুবাদক সেন্ট জেরোমো। পুরো নাম জেরোম অফ স্ট্রিডন। ধর্মতত্তববিদ, ঐতিহাসিক এই লেখকের হাতেই গ্রিক থেকে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল বাইবেলের অধিকাংশ অংশ। যা অনূদিত হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বই হয়ে ওঠে বাইবেল। বইবেল আজ বিশ্বের সর্বাধিক ভাষায় অনূদিত বই।এই ঐতিহাসিক অনুবাদকের মৃত্যু হয়েছিল বেথেলহেমের কাছে। তারিখ ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। এই জেরোমোর স্মরণেই ইদানীং প্রতি বছর বিশ্ব ট্রানস্লেশন ডে হিসেবে পালিত হয়ে চলেছে।

জাতি সংঘের বিচারে এই দিনটি ভাষা বিশেষজ্ঞদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। যে ভাষা বিশ্বের এক ভাষার মানুষের সঙ্গে আরেক ভাষার সংযোগ, সম্প্রীতি, শান্তি ও নিরাপত্তার অবদান রাখে। তৈরি হয় এক ভাষার সঙ্গে আরেক ভাষার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এ কথা অনস্বীকার্য এক ভাষা থেকে অন্যভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনগুলির মধ্যে একটি। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল বলেই রবীন্দ্রনাত নোবেল পেয়েছিলেন। বিশ্বের তাবড় সাহিত্য এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদিত হয়েই সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।এমনকি এক রাজ্যের ভাষাও। যেমন বাংলা ভাষায় আমরা হ্নিুদ ওডিড়য়া, গুজরাতি প্রভৃতি ভাষার সাহিত্য পাঠ করে থাকি। এই কারণেই গডেড় উঠেছে সাহিত্য একাডেমি।

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ট্রান্সসেলেটরস ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস হিসাবে বিশ্বব্যাপী উদযাপন করে। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা এই দিনটি পালন করে এলেও বিশ্বব্যাপী অনুবাদ দিবসের প্রথম আনুষ্ঠানিক উদযাপন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তারপর বেশ কিছু বছর কেটে যাবার পর ২০১৭ সালের ২৪ মে জাতি সংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় অনুবাদক জেরোমের স্মরণে।

মূল উদ্দেশ্য অনুবাদ শিল্প ও বিভিন্ন ভাষার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যা আমাদের সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।এই দিনটিতে ভাষা বিশেষজ্ঞদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার পাশাপাশি বিভিন্ন সভা সেমিনার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

ভাষা সংকট এখন এক অন্যতম সমস্যা। এ বছর ওয়ার্ল্ড ট্রান্সসেলেশনের মূল থিম `ইউনাইটেড ট্রান্সসেলেশন’ এর ওপর ভিত্তি করে। ২০২০ এর থিম ছিল সংকটে থাকা বিশ্বের জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজে বের করা– `ফাইন্ডিং দ্য ওয়ার্ডস ফর এ ওয়র্ল্ড ইন ক্রাইসিস’।

আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বিশ্বের দরজা উন্মুক্ত হচ্ছে আরও বিস্তৃত ভাবে এক দেশের মানুষ কাজের সূত্রে এক দেশে থেকে আরেক দেশে ছুটে যাচ্ছে কিন্তু সেখানে প্রধান সংকট ভাষার প্রতিবন্ধকতা। দোভাষীর সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। গুগল আজ সেই দোভাষীর কাজে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনায়াসে অনুবাদ করে দেয়। সেই অনুবাদের সাহায্যেই আমরা বিশ্বের যাবতীয় অচেনা অজানা ভাষার সাহিত্য পাঠ করে থাকি।

Courtesy: Twitter

বিশ্বের প্রথম অনুবাদিত বই সম্ভবত `গিলগামেশ’। গিলগামেশ ছিল মেসোপটেমিয়া পুরাণের একটি প্রধান চরিত্র। এই গিলগামেশ মহাকাব্য আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে রচিত হয়েছিল কিউনিফর্ম লিপিতে। গিলগামেশ ছিলেন উরুক রাজ্যের রাজা। তাঁর দুঃসাহসিক স্বর্গাভিযানের কাহিনি। আজ বাংলা ভাষাতেও আমরা গিলগামেশ পড়তে পারি। এই অনুবাদের কারণেই যা আজ বিশ্ববিশ্রুত।

বাইবেল, ইলিয়াড-ওডিশি, রামায়ন, মহাভারত এর মতো মহাকাব্যের পাশাপাশি পৃথিবীর সমস্ত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আজ শুধু ধর্ম সাহিত্যই নয়, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির মতো বইও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে কাজে লাগে।

ভাষা একে অপরের সভ্যতার প্রশংসা করে বিভিন্ন সংস্কৃতির পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সহায়তা করে। তাই সেইসব অনুবাদকদের সম্মান জানাতেই ৩০ সেপ্টেম্বর দিনটিকে বিশ্ব অনুবাদ দিবস হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে।

Exit mobile version