চলচ্চিত্রের জাদুকর মারি-জর্জ জঁ মেলিয়্যাস

851
0
mary george melies_1

ভাস্কর ভট্টাচার্য

কথায় বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। তাঁর এক জীবনেই সে রকমটাই যেন করেছিলেন। পৈতৃক সূত্রে একদিকে ছিলেন জুতোর কারবারি অন্যদিকে ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর ছিল জাদুর নেশা। আর সেই জাদুর নেশার সঙ্গে-সঙ্গেই একদিন পৌঁছে গেলেন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায়। শুরুর সেই দিনগুলোয় একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর সে সবের প্রয়োগ চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় মাইল ফলক হয়ে থাকল। সিনেমাকে দিয়েছিলেন নতুন ভাষা। এ সবই এই মানুষটির জীবনকে ঘিরে ওতপ্রোতভাবে ছিল জড়িয়ে। চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, সেট ডিজাইনার, প্রয়োজক থেকে ম্যাজিশিয়ান বা জাদুসম্রাট বা রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রকর কী নন? থিয়েটার বা আধুনিক চলচ্চিত্রের যে অভিনব কৌশল আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি তার কিছুটা হলেও তিনি প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। সিনেমার জন্মলগ্নের সময় থেকে নানা ধরনের প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন প্রতিনিয়ত আর এক-এক একটা অভিনব বিষয় উপস্থাপন করেছিলেন চলচ্চিত্র দুনিয়ায়। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও বেশি আগে প্যারিসের মতো স্থানে (মনট্রিল) তিনিই তৈরি করেছিলেন এক বিশাল স্টুডিয়ো, যার পুরোটাই কাচ দিয়ে তৈরি। এমনকি মাথার ছাদও কাচের। কারণ আর কিছু নয়, সূর্যের আলোকে কেমন ভাবে সিনেমা তৈরিতে ক্যামেরার কাজে লাগানো যায়। এক্সপোজার, সময়সীমা, ফটোগ্রাফি তো বটেই, হাতে এঁকে নানা রঙের দৃশ্য তৈরি করে প্রথম দিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। চলচ্চিত্রবিশ্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য আজও। তিনি মারি-জর্জ জঁ মেলিয়্যাস। ফরাসি বাবা ও ওলন্দাজ মায়ের তৃতীয় সন্তান। বাবার ছিল জুতা তৈরির কারখানা। কিশোর মেলিয়্যাস-এর মাথায় পড়াশোনার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরছে জাদুকর হওয়ার নেশা। পারতেন অসাধারণ ছবি আঁকতে। শিল্পের প্রতি আকর্ষণ বন্ধুরা টের পেত যখন তিনি মাত্র দশ বছর বয়সে কার্ডবোর্ড দিয়ে নানা ধরনের প্রতিকৃতি বা ক্যারিকেচারধর্মী ছবি এঁকে মজা করতেন। কার্ডবোর্ড দিয়ে থিয়েটার স্টেজ বানানো থেকে শুরু করে আরও কত কী! পড়া শেষ করে পারিবারিক জুতোর ব্যবসাই সামলানোর দায়িত্ব বর্তাল। কিন্তু মন টিঁকল না। ঘটনাক্রমে তিন বছরের জন্য বাবার বন্ধুর এক কোম্পানিতে গেল চাকরি করলেন। সেখানেই তিনি পেলেন ইজিপশিয়ান হল। পেলেন নতুন খেলা। সেখানে একদিকে ম্যাজিক দেখা, নানা কৌশল শেখা, অন্যদিকে ম্যাজিক দেখানোর সুযোগও ঘটে গেল। সে সময়ের বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান জন নেভিল ম্যাস্কেলাইনকেও পেয়ে গেলেন সেই কিশোর মেলিয়্যাস। সে এক দারুণ সময়। একদিকে ম্যাজিক দেখা অন্যদিকে জঁ ইউজ্যান রোব্যার উদ্যাঁ নামাঙ্কিত হলে ম্যাজিক দেখানো এবং প্রভূত প্রশংসা পাওয়া। কিন্তু ছেদ ঘটল সেখানেও। পুনরায় তাঁকে ফিরে আসতে হল প্যারিসে জন্মভূমিতে যেখানে রয়েছে পারিবারিক ব্যবসা। আবার যুক্ত হলেন সেই ব্যবসায়। কিন্তু কিছুকাল কাটার পর বিয়ের যৌতুক থেকে পাওয়া অর্থ আর জুতোর ব্যবসার শেয়ার বেচে কিনে নিলেন সেই রোব্যার উদ্যাঁ থিয়েটার হলটিই। সুসজ্জিত, আধুনিক সেই হলটিকে আরও আকর্ষণীয়, আরও উন্নত প্রযুক্তির করে তুললেন এবং সেখানে নাটক অভিনয়ের পাশাপাশি দেখাতে শুরু করলেন রাতের পর রাত অভিনব সব জাদু। যা দেখে দর্শকরা অভিভূত। সেখানেই দেখালেন ‘রেসিডিক্টেন্ট ডিস্যাপিটেড’-এক অধ্যাপক মুণ্ডহীন শরীরে কী করে অনর্গল বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। যা সে সময়ে আলোড়ন তুলেছিল। একদিকে জাদু অন্যদিকে মাথায় এল অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র বানাবার ইচ্ছা। ইতিমধ্যে প্রেম-প্রণয় এবং দ্বিতীয় বিয়ে। অভিনয় জগতের সেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই লেগে পড়লেন সিনেমা তৈরির নানান ভাবনায়। কিনলেন আরও আধুনিক ধরনের প্রোজেক্টর, ক্যামেরা সহ নানাবিধ সরঞ্জাম। যেখানে ক্যামেরা ছিল ‘কফি গ্রাইন্ডার’ বা ‘মেশিন গান’ তুল্য শব্দময় সেই সব ক্যামেরার পরিবর্তে আনতে চাইলেন শব্দহীন আধুনিক ক্যামেরা। ছুটলেন ল্যুমিয়ের ব্রাদার্স, পাথে বা গোমঁ-র মতো আধুনিক ক্যামেরার খোঁজে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রবল উৎসাহেই তৈরি হল আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষা। একের পর এক তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হতে লাগল `ভ্যানিশিং লেডি’, `এ টেরিবল লাইট’, `প্লেয়িং কার্ড’, `আফটার দ্য বল’ সহ অসংখ্য ছবি ও জাদুর মায়া। থিয়েটারের মতো সিনেমাতেও আনতে চাইলেন জাদু ও ছায়ার খেলা যা ইতিমধ্যে কেউ ব্যবহার করেননি। সারা জীবনে প্রায় ৫০০ ছবি সম্পাদনা করেছিলেন এই পরিচালক-জাদুকর। ১৮৯৬ থেকে ১৯১৩ এই ক-বছরের মধ্যে তাঁর হাত দিয়েই বের হয়েছিল ১ মিনিট থেকে ৪০ মিনিটের সব ছবি। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবির কথা তো সর্বজনবিদিত। শুধু জাদুকর বা সিনেমা পরিচালকই ছিলেন না, তিনি যে কত বড় অভিনেতাও ছিলেন তার বড় উদাহরণ তাঁরই তৈরি ‘ওয়ান ম্যান ব্যান্ড’ ছবিটি। যেখানে তিনি একাই সাতটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীকালে খুলেছিলেন স্টার ফিল্ম কোম্পানি। জাদু ও সিনেমা একই সঙ্গে চালিয়ে গেছেন। সকাল সাতটা  থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ছিল সিনেমার জন্য বরাদ্দ আর ঠিক সন্ধ্যা সাতটা বা আটটা থেকে থিয়েটারের বা জাদুকরের ভূমিকায় তিনি। ফিল্মেও বারেবার আনতে চেয়েছিলেন ম্যাজিকের নানা উপস্থাপনা যা দশর্ককে অভিভূত করত। তাঁর অসাধারণ সেইসব সৃষ্টির কথা ভুলতে পারবেন না সিনেমাপ্রেমী মানুষ। ‘এ ট্রিপ টু দ্য মুন’ যেখানে তিনি আইকনিক ইমেজ ব্যবহার করেছিলেন, এ ছাড়াও ‘সিন্ডারেল্লা’, ‘অ্যাস্ট্রোনমার’স ড্রিম’, ‘দ্য হন্টেড ক্যাসল’, `আফটার দ্য বেল’ প্রভৃতি তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। জীবনের বাঁকে-বাঁকে বৈচিত্র্য আর অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে এগিয়ে গেছেন। তাই তো তিনি বলেছেন, জীবনের চরম অভিজ্ঞতাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এক সময় রাস্তায় খেলনার দোকান দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য শিল্পীদের সাহায্যের জন্যই বিক্রয়লব্ধ অর্থ দান করেছেন। ৭৬ বছর বয়সে বর্ণময় প্রতিভাবান এবং নতুন শিল্পের অনুরাগী এই মানুষটিই যখন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দিন গুনছেন এবং শেষ দি্নে অনুগ্রাহীরা ভিড় করলে ক্যারিকেচার ধর্মী খেলনা তৈরি করে বলেছিলেন হাসো বন্ধু হাসো, আমার সঙ্গে হাসো, আমার জন্যে হাসো, বিকজ, আই ড্রিম ইয়োর ড্রিমস।