নৃত্যের তালে-তালে: ভাগ্যিস সেদিন মেয়ের বিদেশ যাবার আবদার বাবা মেনে নিয়েছিলেন! অমলাশঙ্কর (১৯১৯_২০২০)

1697
0

সেদিন ছোট্ট মেয়েটার বায়না যদি বাবা না মেটাতেন তাহলে হয়তো অমলা নন্দী আসমুদ্র হিমাচলের অমলাশঙ্কর বা ‘ইন্ডিয়ান ফিউশন ডান্সে’র পুরোধা হয়ে উঠতেন কিনা এটা একটা বড় জিজ্ঞাসা।  এই অমলাশঙ্কর গত ২৭ জুন শতায়ু জীবন পেরিয়ে একশো এক বছর পূর্ণ করেছিলেন। আর ২৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
মেয়ের যখন বয়স মাত্র ১১ বছর, তখন যশোরের স্বর্ণব্যবসায়ী বাবা অক্ষয় কুমার নন্দী ১৯৩০ সালে এক ব্যাবসায়িক সম্মেলনে প্যারিসে  অংশ নিতে যাবার উদ্যোগ করছেন। মেয়ের বায়না, সেও সঙ্গে যাবে। কিন্তু মেয়েরা আবার বাইরে বেরোবে কী! ঘরই তো তাদের সব! এদিকে মেয়েও নাছোড়বান্দা। অনেক টালবাহানার পর বাবা কিশোরী মেয়েকে নিয়ে যেতে রাজি হন।  ভারতীয় অলংকারকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচয় করাতে ব্যাবসায়িক কারণে বাবাকে বিদেশ যেতে হয়।  অবশেষে মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে মেয়েকেও নিয়ে পাড়ি দিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবা।  তখনও কেউ জানে না সেখানে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছে এক প্রতিভার বিস্ফোরণ। সেখানে তখন এক উদীয়মান দ্যুতিমান তরুণ একাত্ম হয়ে নৃত্যশিল্প সাধনায় মগ্ন। ‘হিন্দু ডান্স’ প্রদর্শন করে বিশ্বজোড়া নাম। সেই তরুণের নাম উদয়শঙ্কর। বাবা শ্যামশঙ্কর চৌধুরীও এক সময় বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার। পরে যোধপুরের বাসিন্দা। বাবা যোধপুরের ব্যারিস্টারি ছেড়ে লন্ডনে পৌঁছেছেন, শিল্পের প্রসার ঘটানোর কাজে। সেখানেই নতুন করে পরিচয় হয় দুই পরিবারের। পরিচয় হয় অমলার সঙ্গে উদয়ের। পরিচয় হয় ‘রবুর’ সঙ্গেও। অর্থাৎ রবিশঙ্করের। উদয়শঙ্করই অমলাকে নাচের নেশা ধরান। শেখান সকল মুদ্রা।
যে মেয়ের ধ্যান-ধারণায় ছিল না নৃত্যের স্বপ্ন, সেই মেয়েকেই উদয়শঙ্কর তাঁর বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নাচের মুদ্রা শিখিয়ে সঙ্গে করে পাড়ি দিলেন ইউরোপের নানা প্রান্তে। গড়েছেন দল। উদ্বুদ্ধ হয়েছেন রাশিয়ান শিল্পী আনা পাভলোভার মতো গুণীর সান্নিধ্যে। উদয়শঙ্করের ভাবনায় তখন নতুন কিছু করার আগ্রাসী প্রয়াস। একদিকে ইউরোপীয় ঘরানার থিয়েট্রিক্যাল নৃত্যভাবনা, অন্যদিকে সাতটি  ভারতীয় ধ্রুপদী ঘরানার নৃত্যের সঙ্গে লোকনৃত্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে চালাচ্ছেন নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। উৎসাহী মহলে ভরত নাট্যম, কথাকলি নৃত্যের সঙ্গে ইউরোপীয় নৃত্যের সংমিশ্রণে ‘কালীয় দমন” শিব-পার্বতী’র নটরাজ নৃত্য, বা ‘কার্তিকেয়’ সনাতনী ভারতীয় ভাবনায় অমলা- উদয় মঞ্চ মাতাচ্ছেন, করতালি প্লাবিত ৎচ্ছেন দেশে -বিদেশে। প্রশংসায় পঞ্চমুখ নেতাজি সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ। এমন এক উজ্জ্বল সময়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আহ্বান করলেন এক নতুন ঘরানা সৃষ্টিকারী এই প্রতিভাদ্বয়কে ভারতে কিছু করার। রবীন্দ্রনাথ সেদিন একটা পূর্ণাঙ্গ নৃত্যশিল্পের অ্যাকাডেমি গড়ার জন্য আহ্বান জানালেন এই দম্পতিকে। সেই আহ্বানে সাড়াও দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে। বিধানচন্দ্র রায়ের উৎসাহে গড়ে উঠেছিল নৃত্য শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েস্টবেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব ডান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক’ যা পরে বহুবিস্তারের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
উদয়শঙ্কর বিদেশি নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে যে‌ ‘লেজেন্ডারি’ নৃত্যশৈলী সৃষ্টি করেছিলেন, তার অন্যতম সহযাত্রী ছিলেন অমলা নন্দী থেকে হয়ে ওঠা অমলাশঙ্কর। অমলার নৃত্যের শরীরী  ভঙ্গিমা, মুদ্রার ভাষা যেন জীবন্ত হয়ে উঠত এক-একটা নৃত্যের রূপায়ণে। তা যাঁরা তাঁর  ‘কালীয় দমন’, ‘শিব পার্বতী’, ‘যমুনাকে তীরে’ দেখেছেন এক কথায় স্বীকার করবেন। সেই পথ ধরেই স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অমলার প্রতিভায় উদয়শঙ্করের ভাবনায় ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্রে।  ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি তৈরি হওয়া এই ‘কল্পনা’ ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য নিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম তৈরি হওয়া ছবি। যা সারা বিশ্বে শুধু আলোড়ন‌ই তোলেনি, এই দম্পতিকে দিয়েছিল স্বতন্ত্রতা। নৃত্যের পথিকৃতের হাতে সেদিন জন্ম নিয়েছিল এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা।
১৯৪২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর অনেক কাহিনি। দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠানের ডাক। তোলপাড় করা খ্যাতি আর মহিমা। এমনকি উদয়শঙ্করের স্মরণে প্রকাশিত হয়েছিল ভারতীয় ডাক টিকিট।  ১৯৬১র রবীন্দ্রশতবার্ষিকীতে কলকাতায় অমলা-উদয় মিলে উপস্থাপন করলেন ‘সামান্য ক্ষতি’।
উদয়শঙ্কর অমলাশঙ্কর মিলে গড়েছিলেন ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার। যার প্রধান তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করেছেন অমলা নিজে এবং পরে যার নাম হয়েছিল ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার আলমোড়া সেন্টার ফর ডান্স।’
উদয়শঙ্কর যদি আধুনিক ভারতীয় নৃত্যের পুরোধা পুরুষ হয়ে থাকেন, তাহলে অমলাশঙ্কর সেই শঙ্কর ঘরানার অন্যতম বাহক। উদয় ঘরানাকে অবলম্বন করে দীর্ঘ ৫০ বছর নিরলস ভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন অসংখ্য ছাছাত্রী তৈরি করা ও দেশে-বিদেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া। ২০১৫ সাল অবধি চলেছিল সেই স্কুল। উদয় শঙ্কর  ক্রিয়েটিভ নৃত্যের ভাবনায় নানা নামে নানা পরিবেশনা করেছেন। অমলা নিজস্ব ভাবনায় গড়েছিলেন ‘সীতা স্বয়ম্বরা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ , ‘কাল মৃগয়া’, ‘বাসবদত্তা’, ‘ সামান্য ক্ষতি’ ‘মহামানব’, ‘লেবার অ্যান্ড মেশিনারি’র মতো নানা উপস্থাপনা। পুত্র আনন্দশঙ্করের কম্পোজিশনে ‘যুগ ছন্দ’। 
দীর্ঘ শতায়ু জীবন নানা ছন্দে বাজলেও এক সময় জীবনের সুরও কেটেছিল। উদয়শঙ্কর অমলাকে ছাড়াই করেছিলেন ‘চণ্ডালিকা’। 
সম্পর্কহীন জীবন কাটালেও শঙ্কর ঘরানাকে মুছে ফেলতে পারেননি, বরং আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁরই উত্তরসূরি মমতা শঙ্কর, তনুশ্রীশঙ্কর, শ্রীনন্দাশঙ্কর সহ অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের স্কুল নিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের  নিয়ে ভেবেছেন। যততদিন শক্তি ছিল ততদিন মষপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। 
তাঁর আজীবন নৃত্য পরিবেশনায় দেশে-বিদেশে সম্মানের ছড়াছড়ি। ১৯৯১ সালে ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান দেয়। লিখেছেন, ‘ সাত সাগরের পারে’ এবং ‘শঙ্করনামা’ নামে দুটি বই। 
এই মহান শিল্পীর জীবনাবসানের সঙ্গে-সঙ্গে এক শতাব্দীখ্যাত শিল্পীর শিল্প প্রতিভারও অবসান ঘটল। উদয় শঙ্কর অনেক আগেই (১৯৭৭) গেছেন, এবার অমলাশঙ্করও গেলেন। আধুনিক ভারতবর্ষের নৃত্যের ইতিহাসে যে নারী প্রমাণ করেছিলেন সুযোগ পেলে নারীও দেখিয়ে দিতে পারে, রাখতে পারে তার প্রতিভার স্বাক্ষর। বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে আর পাঁচজনের মতোই সাধারণ ঘরণী হয়ে থাকবে। কিন্তু অমলা নিজের নিরলস শ্রম ও মেধা দিয়ে বিশ্বকে জয় করে নিয়েছিলেন নৃত্যের তালে।
উল্লেখ্য, এই দম্পতি দুজনেই পেয়েছিলেন পদ্মভূষণ সম্মান। অমলাশঙ্কর সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি টেগোর রত্ন, ‘বঙ্গ বিভূষণ’ ইত্যাদি নানান সরকারি-বেসরকারি উল্লেখযোগ্য সম্মানে ভূষিত। আমরা অনেকেই জানি না, তিনি শুধু একজন নৃত্যশিল্পীই নন, একজন চিত্রকরও।
                                                                                                                                  ভাস্কর ভট্টাচার্য
লাইভ টিভি দেখুন :       https://chetana.tv/
বাংলার প্রথম এডুকেশনাল চ্যানেল