ইরফান খান
এক প্রতিভার মৃত্যুর পর সেই প্রতিভাকে ঘিরে অনেক প্রতিভার খবর উঠে আসে। যেমন বিশিষ্ট অভিনেতা ইরফান খানের বেলাতেও। কেউ কেউ লিখছেন তিনি নামকরা ক্রিকেটার হতে পারতেন। অথবা ব্যবসায়ী। কিন্তু তিনি অভিনয়ের জগতকে বেছে নিয়েছিলেন। রাজস্থানের জয়পুরে এক নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে বলিউড ও হলিউড দুনিয়ায় নিজস্ব প্রতিভার স্ফূরণ ঘটানো সহজ কাজ নয়, সেই কঠিন কাজটিই করে দেখিয়েছেন অকাল প্রয়াত “দ্য মোস্ট অরিজিনাল এক্সপ্রেসিভ” অভিনেতা ইরফান খান।
এমএ পাশ করে অভিনয় শিল্প জগতে পাঠ নেওয়া এবং চলচ্চিত্র জগতে নিজের প্রতিভার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান যেমন দেখিয়েছেন, অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, তেমনি নানা সম্মান কুড়িয়েছেন।
সেই ইরফান খান চলে গেলেন মাত্র ৫৩ বছর বয়সে।। লক ডাউনের মধ্যে নীরবচুল্লিতে লীন হয়ে গেলেন। নিউরোনডক্রিন টিউমার তাঁর মৃত্যু দূত হয়ে কয়েকবছর আগেই হাজির হয়েছিল। এতদিনে সব শারীরিক-মানসিক লড়াই শেষ।
জীবন মানে যুদ্ধ, প্রেম, বিষাদ, আবার জীবনে নতুন করে ফিরে আসার লড়াই। অন্তত ইরফানের অভিনীত লাইফ অব পাই সেই বার্তাই দিয়েছে। হলিউডের এই ছবি বিশ্ব সিনেমার অনন্য ছবিগুলির মধ্যে একটি। যেখানে জীবন ও মৃত্যু এক সুতোয় দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে।
আংরেজি মিডিয়াম, পিকু, দ্য লাঞ্চবক্স, ইনফার্নো, জুরাসিক ওয়ার্ল্ড, স্লামডগ মিলেনিয়াম, ওয়ারিয়র, হাসিল, মাদারি, বা বাংলাদেশের ছবি ডুব সহ অসংখ্য ছবিতে তিনি তাঁর বিচিত্র চরিত্রে অভিনয় করার যে অনন্যতা দেখিয়েছেন, তা সিনেমা শিল্পের ইতিহাসে এক বিশেষ অভিনেতার মর্যাদাই আদায় করে নিতে বাধ্য। যেমন ভাবে পদ্মশ্রী সম্মান সহ সেরা অভিনেতার সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন। পান সিং তোমর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল।
পুরো নাম শাহাবজাদে ইরফান আলি খান। জন্ম জয়পুরে ১৯৬৭ সালে। বাবার ছিল পাগড়ির ব্যবসা। এনএফএসডিতে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। টেলিভিশন অভিনয় দিয়ে শুরু। পরিচয় হয় স্ক্রিপ্ট রাইটার সুতপা শিকদারের সঙ্গে। বিয়ে। আরও অনেক দেবার ছিল, আমাদের পাওয়ারও ছিল। কিন্তু সব থেমে গেল। উল্লেখ্য, মাত্র চারদিন আগেই, তাঁর মা প্রয়াত হয়েছেন।
ঋষি কাপুর
এলেন, দেখলেন, জয় করলেন এ কথাটা ঋষি কাপুরের ক্ষেত্রে ধ্রুব সত্য। প্রথম ছবিতেই নায়ক এবং ফিল্ম ফেয়ার ও বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ইতিহাস সৃষ্টি করছিলেন এই অভিনেতা। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় চকোলেট বয় বা লাভার্স বয় হিসেবেও একসময় আলোড়িত।
সেদিন বাবা ঋষিরাজ কাপুর যদি রাজশাহী খান্নাকে দিয়ে ববি করাতে না পারতেন তাহলে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে চলচ্চিত্রে ঋষি কাপুরের অভিষেক ঘটত কিনা সন্দেহ। ঋষি কাপুরের গোটা পরিমণ্ডলটাই ছিল অভিনয় দুনিয়ার। দাদু পৃত্থীরাজ কাপুর, বাবা মেরা নাম জোকার খ্যাত রাজ কাপুর। কাকা শামী কাপুর ও শশী কাপুর। এ ছাড়াও এই পরিবারের প্রেমনাথ, প্রেম চোপড়া সহ অনেকেই অভিনয় জগতের সঙ্গে জড়িত। এমন পরিমণ্ডল থেকেই পর্দায় আসা প্রথম ছবি ববি সত্তর দশকের সাড়া জাগানো কিশোর প্রেমের ছবি। এত উন্মাদনা শোলে সিনেমার সঙ্গেই শুধু সেদিন আলোচিত হত। যাঁরা একটু সিনেমার খবর রাখেন সেসময়ে একই ধাঁচে আরেকটি ছবি তৈরি হয়েছিল। নাম জুলি। কিন্তু সেদিন সব আলো লেগেছিল ববির গায়ে।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯২ প্রায় নব্বই ছবিতে ঋষি কাপুর উল্লেখযোগ্য রোলে অভিনয় করেছেন। খেল খেল মে, কভি কভি, হম কিসি সে কম নহি, সাগর, প্রেম রোগ সহ অসংখ্য উল্লেখযোগ্য হিট ছবি করেছেন ঋষি কাপুর। বয়স যত বেড়েছে ততই পালটে দেন অভিনয়ে চরিত্রের ধরন।। ২০১৬ সালে ‘কপুর অ্যান্ড সন্স’ উল্লেখযোগ্য ছবি। পেয়েছিলেন ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড। তার অনেক আগে ২০০৮ সালে পেয়েছেন লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। আক্রান্ত হন লিউকোমিয়া রোগে। দীর্ঘ চিকিৎসায় সাময়িক সুস্থ হলেও শেষ রক্ষা হল না। ৬৭ বছরে জীবনে বড় দাঁড়ি পড়ে গেল। তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্ত্রী সিনেমার সাড়া জাগানো অভিনেত্রী নীতু সিং নীতু কাপুর হয়েছিলেন। দর্শকদের মনে পর্দার সদা হাস্যময় লাভার্স বয় হয়েই বেঁচেছিলেন শেষদিন পর্যন্ত।
চুনী গোস্বামী
বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের দিকপাল পি কে ব্যানার্জির পর চলে গেলেন প্রতিপক্ষের দলনায়ক চুনী গোস্বামীও। সব্যসাচী বলত যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাইই, তার থেকেও একটু এগিয়ে। অন্তত বাংলা বাঙালি জীবনে ফুটবলকে যে সব ব্যক্তত্ব জনপ্রিয় করছিলেন তাঁদের মধ্য চুনী গোস্বামী একজন। ফুটবল এবং ক্রিকেটে অলরাউন্ডার ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে খেলার মাঠ চিনে ছিলেন, এবং ময়দানে মোহনবাগান ক্লাবে ফুটবলে হাতে খড়ি। বাকি গোটা জীবন মোহনবাগান ক্লাবই ছিল তাঁর সব। কেউ-কেউ তাই একসময় মজা করে বলতেন ওই মোহনবাগান আসছেন।
ফুটবলের প্রতি আজীবন প্রেম থাকলেও ১৯৪৬ সালে ক্রিকেটে রঞ্জি ট্রফিও খেলেছিলেন। শুধু ফুটবল ক্রিকেট নয়, নিয়মিত সবার অগোচরে খেলতেন লন টেনিস। কলকাতার সাউথ ক্লাবে। আপাদমস্তক খেলোয়াড় ছিলেন চুনি গোস্বামী। খেলার মাঠ তাঁকে চুনী গোস্বামী হিসেবে চিনলেও পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল সুবিমল গোস্বামী।
১৯৫৪ সাল থেকে শুরু। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত পঞ্চাশটিরও বেশি ম্যাচ খেলেছেন ভারতীয় দলের হয়ে। ১৯৬২ সালে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন এশিয়ান গেমসে। সে বছর ভারত এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিল। ১৯৬৪ সালে এশিয়া কাপে রুপো জিতেছিল ভারতীয় দল। মারডেকা কাপেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। মারডেকা কাপ এখন আর হয় না তাঁর খেলোয়াড় জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল নানা কৃতিত্বে ভরা।
সেই কৃতিত্বের জন্যই পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মান। তিনি শুধুই সম্মান পাননি বাংলা তথা ভারতের ফুটবলকে আন্তজার্তিক পরিচয় ঘটিয়েছিলেন দলের হয়ে খেলা প্রদর্শন করে। ১৯৬২ সালে বেস্ট স্ট্রাইকার অব এশিয়া অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে পেয়েছিলেন অর্জুন পুরস্কার আর ১৯৮৩ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। তাঁর আজীবনের প্রিয় দল তাঁকে ২০০৫ সালে দিয়েছিল মোহনবাগানরত্ন। তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম বড় সম্মান পেয়েছিলেন বোধহয় কলকাতার শেরিফ হয়ে। জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। ময়দানের বাইরে টাটা অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর হয়েছিলেন। ছিলেন বিশেষ পরামর্শদাতা। অনেক নতুন ফুটবলার তৈরি করেছিলেন। এমনকি বাংলা প্রথম প্রেম নামক একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। বাংলা বা ভারতের এই স্বনামধন্য স্ট্রাইকার ফুটবলারের প্রয়াণ এমন এক সময় যখন ময়দানের ফুটবলের দলগুলিতে বাঙালি খেলোয়াড়ের নাম গুটিকতক। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
উল্লেখ্য, গত রবিবার বাংলার ফুটবলের আরেক বিশিষ্ট খেলোয়াড় মারা যান, তিনি শান্ত মিত্র৷ বয়স হয়েছিল ৭২ বছর৷ বেশ কয়েক বছর ক্যানসারে ভুগছিলেন৷ তিনি জাতীয় দলের হয়েও খেলেছিলেন৷