রাচেল লুইস কার্সন প্রকৃতির পাঠ শিখিয়েছিলেন

2582
0

ভাস্কর ভট্টাচার্য
ইতিহাসের দুর্ধর্ষ পুরুষ নেপোলিয়ন বোনাপার্ৎ বলেছিলেন তুমি আমায় একটা সুন্দর মা দাও,  আমি তোমায় একটা সুন্দর দেশ দেব। অন্তত প্রকৃতি বিজ্ঞানী রাচেল কারসন তেমনই এক মা পেয়েছিলেন। পুরো নাম রাচেল লুইস কারসন। স্প্রিং ডেলে ওদের বাড়িটা ছিল প্রকৃতি মোড়া। আপেল আর মেপল গাছ দিয়ে ঘেরা। পাশ দিয়ে বয়ে যায় অ্যালিসন নদী। শিশু রাচেল মাত্র দশ বছর বয়সেই  লিখে ফেলল আড়াইশো শব্দের একটা গল্প। সেটা সে সময়ের সেন্ট নিকোলাস পত্রিকায় ছাপা হল। মনে মনে ভাবত বড় হয়ে সে মস্ত লেখক হবে। হ্যাঁ, তিনি মস্ত লেখক হয়েছিলেন। তাঁর লেখা বই পৃথিবী জোড়া নাম।  তাঁর লেখা নিয়ে তৈরি সিনেমা অস্কার পুরস্কারের সম্মান পেয়েছে। যত সহজ মনে হয় তা তো নয়, কোনো মানুষের জীবনই বোধহয় সহজে উচ্চ শিখরে পৌঁছয় না।
মা ফ্রেজিয়ার ম্যাক লিয়েন ছিলেন মগ্ন পাঠক। প্রচুর বই পড়তেন। চাইতেন ছেলেমেয়েরা বই পড়ূক। নিজেরা কিছু লিখতে শিখুক।  আর বেশি করে চিনুক প্রকৃতিকে। গাছপালা পাখি দেখা, পাখির ডাক, এ সবই রাচেল চিনত, শিখত তার মার হাত ধরে। পাখিদের আচরণ, পোকা-মাকড়ের চলাফেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে উপলব্ধি করত এক অনন্য অনুভূতি দিয়ে,  যা মা মেয়ের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিলেন। মা ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অলিভার থর্ন মিলার, ফ্লোরেন্স মেলিয়াম বেইলির মতো মহিলা লেখকদের বই যা সব প্রাণিজগতের নানা রহস্য নিয়েই লেখা। হাতে তুলে দেন হ্যান্ডবুক অব নেচার স্টাডির মতো সব বই। রাচেল মজা পেত ছবি আঁকতে ওইসব প্রাণীদের নিয়ে।ছোট্ট রেন পাখিদের ডাক ওর মনকে উদাস করে দিত।
আর্থিক কারণে প্রথমে না পারলেও পরের বছর ১৯২৯ সালে সাম্মানিক স্নাতক হয়ে ভর্তি হলেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩২-এ জিওলজিতে এমএ। সেখানেই গবেষণা শুরু। শুরু জীবনের দুর্দিনেরও। অনটন পরিবার ঘিরে। গোটা সংসারের দায়িত্ব নিয়ে গবেষণা থামিয়ে খুঁজলেন পুরো সময়ের শিক্ষকতার চাকরি। সদ্য পিতৃহারা রাচেল। সেসময়ে পেলেন শুভানুধ্যায়ী মেরি স্কট স্কিনকারকে। শুরু করলেন রোজগারের জন্য লেখালেখি। বিষয় ‘জলের তলার বিস্ময়কর কাহিনি’। একটু আলোর দিশা পেলেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হলেন রাচেল কারসন।  এক নিরিবিলি প্রান্তে একদিকে চাকরি, অন্যদিকে মনের বাসনা পূরণ। নানা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। আটলান্টিক মান্থলিতে ছাপা হল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব ওয়াটার্স’। বিস্তৃত হয়ে সেটিই প্রকাশ পেল ‘আন্ডার দ্য সি উইন্ড’ নাম দিয়ে। তারপর ‘দ্য সি অ্যারাউন্ড আস’।  পর-পর দুটি বই। শুধু ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড সম্মান নয়, দু-দুটো সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিও জুটল। অস্কারজয়ী সিনেমাও তৈরি হল এই বইকে ঘিরে। এই সম্মান এই খ্যাতি নিয়ে রাচেল পূর্ণসময়ের জন্য লেখালেখিতেই মনোনিবেশ করলেন।
এক নিরিবিলি প্রকৃতি নির্ভর জায়গায় শেষ করলেন সমুদ্র বা সাগর ট্রিলজি ‘দ্য এজ অব দ্য সি’ (The Edge of the Sea)। যেখানে তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন বিশেষ-বিশেষ জায়গায় কেন বিশেষ-বিশেষ প্রাণীরা থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক। সাগরজলের তাপমাত্রা থেকে প্রকৃতির বুকে বেঁচে থাকা প্রাণীদের কী সম্পর্ক। গোটা জীবন ধরেই প্রকৃতির প্রতি এক ভালবাসা নিয়ে কাটিয়েছিলেন। যা পেয়েছিলেন মার থেকে।
এই অবধি লিখে থেমে যাওয়া যেত। কিন্তু সেদিন রাচেলকে লড়াই করতে হয়েছিল সে সময়ের তাবড়-তাবড় বহুজাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে। প্রকৃতির ওপর কীটনাশক ডিডিটি ব্যবহারের বিরুদ্ধে তীব্র সরব হলেন এই লেখিকা। শুরু করলেন প্রতিবাদী জনমত তৈরির লেখা। অতিরিক্ত কৃষিবিষ আকাশ থেকে প্রয়োগের ফলে শুধু কৃষি নয়, কীভাবে গোটা পক্ষীকুল বিপদের সম্মুখীন ও বিপন্ন, ফলে আমাদের মনুষ্য জীবনও কেমনভাবে বিষময় হয়ে উঠছে। প্রশ্ন তুললেন ডাই এলড্রিন, টক্সাফেন, হেপ্টাক্লোর-এর ব্যবহার নিয়ে। শুধু প্রকৃতিকে নয়, মানব সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে এই প্রয়োগ। বহুজাতিক সংস্থা মামলা ঠুকল, প্রাণের ভয় দেখাল, এমনকি ধনতান্ত্রিক সমাজ তাঁকে চিহ্নিত করল একজন কমিউনিস্ট হিসাবে। কেউ বললেন ‘হিস্টিরিয়ায়গ্রস্ত।’
কোনো বাধা থামাতে পারেনি তাঁর লেখনীকে। ১৯৬২ সালে মৃত্যূর দুবছর আগে প্রকাশ পেল ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। মানব সমাজকে সচেতন করার প্রথম বই। আধুনিক পরিবেশ সচেতনার পথিকৃৎ হিসেবে গোটা আমেরিকায় জয়জয়কার উঠল রাচেলের নামে। প্রশংসা আর নানা সম্মানে ভূষিত হলেন। মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পর  ১৯৮০ সালে পেয়েছিলেন আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান।  ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি মারা যান স্তন ক্যান্সারে।
আজ বিশ্বময় মানবসভ্যতা যখন স্তব্ধ, থমকে গেছে, সর্বশক্তিমান মানুষ এক অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই করছে, নানা প্রান্ত থেকে সংবাদ আসছে কোথাও গোটা সমুদ্র পাড় ধরে ডলফিন, কচ্ছপ অস্বাভাবিক ভাবে ভেসে ওঠে, কোথাও প্রকাশ্যে শহরের বুকে ময়ূর পেখম তুলে তার সৌন্দর্য জানান দিচ্ছে, তখন বারেবার প্রকৃতি বিশারদ সেই লেখিকার সজাগ হবার বার্তা যেন  আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। প্রকৃতি থেকে যিনি পাঠ নিতে, প্রকৃতিকে পড়তে শিখিয়ৈছিলেন, তাঁর প্রকৃতিপ্রেমী মার কাছ থেকে।