ভয়েস অব দ্য মিলেনিয়াম : দেখে নিন একনজরে লতা মঙ্গেশকর

1856
0
Lata Mangeshkar

রয়ে গেল কোকিল কণ্ঠ, সুরের উন্মাদনা আর কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা। নশ্বর দেহকে ফেলে রেখে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ভারতের সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। (Lata Mangeshkar)

১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে সুর সাধনায় ব্রতী পরিবারে জন্ম নেন হেমা (পরবর্তীতে নাম হয় লতা) মঙ্গেশকর। ছোটবেলা থেকেই ওনার পিতা সুরকার দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছে সঙ্গীত জগতের সাথে ভালোবাসায়  জড়িয়ে পড়েন তিনি। জীবনের প্ৰথম ধাক্কাটা আসে মাত্র তেরো বছর বয়সে। ১৯৪২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ পরলোক গমন করেন দীননাথ। তারপর থেকে একদিকে পরিবারের বড় ‘দিদি’ হিসাবে মা, চার ভাইবোনকে (মিনা , আশা, উষা, হৃদয়নাথ) নিয়ে শুরু হয় জীবন সংগ্রাম, আরেকদিকে সংগীত জগতের   সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে নিয়ে যাওয়ার সাধনা। মঙ্গেশকর পরিবারের অভিবাভক হিসাবে বিনায়ক দামোদর কর্ণাটকি লতা মঙ্গেশকরকে প্রথম তার মিউজিক কোম্পানির মাধ্যমে মারাঠি ফিল্ম ‘কিত্তি হাসাই’ (১৯৪২) সিনেমায়  গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন। সেই কোম্পানির যোগসূত্র ধরে লতাজি ১৯৪৫ সালে মুম্বাই চলে আসেন। ১৯৪৬ সালে প্রথম “আপ কি সেবা মেইন”  হিন্দি সিনেমায় লতাজি গান করেন ‘পা লাগু কর জোরি”. সেই থেকে পথ চলা শুরু। প্রথমে উস্তাদ আমন আলি খান-এর কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন হিন্দি ক্লাসিকাল গানের।

বিনায়ক সাহেবের মৃত্যুর পর গুলাম হায়দার লতাজি’র সুর সাধনার পথ প্রদর্শক হয়ে ওঠেন। শোনা যায়, ১৯৪৮ সালে ‘শহীদ’ সিনেমায় গানের রেকর্ডিংয়ের সময় প্রোডাকশন থেকে বলা হয়েছিল লতার স্বর গলা খুব পাতলা, পরবর্তীতে তাঁর  গাওয়া গান বাতিল করা হয়। গুলাম হায়দার সাহেব সেদিন বিরক্ত হয়ে জানিয়েছিলেন “এই মেয়েকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্য একদিন সুরকার, পরিচালকরা ওনার পায়ে এসে পরবে” .. বিধির লিখন শুরু হতে থাকে সেইদিন থেকে। ৪৮ সালে “মজবুর” সিনেমায় ‘দিল মেরা তোরা, মুঝে কহিন কা না ছোড়া ” গান থেকে একটু একটু করে পরিচিতি পেতে শুরু করে তাঁর গান।

এরপর  ১৯৪৯ সালে বিখ্যাত অভিনেত্রী মধুবালা’র ঠোঁটে লতাজির গাওয়া গান “আয়েগা আনেওয়ালা “।  এরপর থেকেই মাইল ফলক তৈরি হতে থাকে একের পর এক। এ দেশের মাটি সর্বকালীন সেরা সুর সম্রাজ্ঞীর পরিচয় পেতে শুরু করে। পঞ্চাশ, ষাট , সত্তর থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সার দেশের প্রতিটা কোণায় পূজিত হতে থাকে তাঁর কণ্ঠ, তাঁর সুর, তাঁর  গানের মাধুর্যতা। নওশাদ আলী, শংকর জয়কিষান, শচীন দেব বর্মন থেকে শুরু করে সি. রামচন্দ্র, সলিল চৌধুরী, আর.ডি. বর্মন, হেমন্ত কুমার, লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল, এমনকি আধুনিক যুগের আনন্দ-মিলিন্দ, নাদিম-শ্রাবন, জতীন-ললিত, আদেশ শ্রীবাস্তব, এ.আর.রহমান প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা সুরকারের হাত ধরে দেশের মানুষ পেয়েছে তাঁর কণ্ঠে অগুনতি চিরকালীন গান।

মোহম্মফ রফিক এবং কিশোর কুমার-এর সাথে জুঁটি বেঁধে লতাজির প্রচুর গান ভারতবর্ষের সঙ্গীত সাধনার একেকটা মাস্টারপিস হিসাবে রয়ে গেছে। মোট ৩৬ টি ভাষায় গান গেয়েছেন লতাজি। রোমান্টিক মেলোডিয়াস গানের পাশাপাশি গজল গান, দেশাত্মবোধক গানেও রয়েছে তাঁর প্রচুর অবদান। নিজে জীবনে অনেক চলচ্চিত্রে সুরকারের ভূমিকাও পালন করেছেন। ১৯৬৩ সালে চীন যুদ্ধের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী  জওহরলাল নেহেরুর পাশে দাঁড়িয়ে সি. রামচন্দ্র’র সংগীত পরিচালনায় তাঁর গান “অ্যায় মেরে বতন কি লোগো, যরা আঁখ মে ভর লো পানি” চোখে জল দিয়েছিল প্রত্যেক ভারতবাসীর মনে। আন্তর্জাতিক স্তরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় গায়িকা হিসাবে সম্মানিত হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সন্মান। “নাইটেঙ্গেল  অব ইন্ডিয়া”, “ভয়েস অব দ্য মিলেনিয়াম” এরকম একাধিক বিশ্ববরেণ্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০০১ সালে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সন্মান “ভারতরত্ন” পুরস্কারে ভূষিত হন লতাজি।

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, আজকের দিন তাঁর চলে যাওয়াটা রাষ্ট্রীয় শোকের পরিমণ্ডল এনে দিয়েছে। তিনি চলে গেলেও, এ দেশের জল, মাটি, হওয়ার সাথে সর্বক্ষণ মিশে থাকবে তাঁর সুরের সৌন্দর্য্য। প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে গুনগুন করে বেজে যাবে তাঁর পাহাড়প্রমাণ সংগীত সম্ভার।

-: লতা মঙ্গেশকর একনজরে  :-

  • জন্ম – ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯, ইন্ডোর, মধ্যপ্রদেশ
  • ৩৬ টি ভাষায় ১০ হাজারের অধিক গান
  • পদ্মভূষণ – ১৯৬৯
  • দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার- ১৯৮৯
  • পদ্মবিভূষণ – ১৯৯৯
  • ভারতরত্ন – ২০০১
  • ন্যাশনাল অর্ডার অব দ্য লিজিয়ন অব হনার (ফ্রান্স সর্বোচ্চ সন্মান)- ২০০৬